দুই চাকার সপ্ন পূরণের গল্প (লিখেছেন- সালমান রহমান পিয়াল)

একটা গল্প বলবো আজ, জীবনের গল্প, স্বপ্নপূরণের গল্প।
স্বপ্ন যেমন ইয়া বড় হয় গল্পটাও তেমনি ইয়া বড়, তাই যাদের বড় পোস্ট পড়ার ধৈর্য নাই তাদের জন্য শুরুতেই ওয়ার্নিং! 😅

গল্পের শুরুটা হয় ‘০৩ সালে যখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি, আমার মেজো চাচা যিনি গ্রামের হাইস্কুলের হেডমাস্টার, স্কুলে যাতায়াতের জন্য একটা মোটরবাইক কিনলেন। গ্রামের বাড়িতে গেলে চাচার মোটরবাইকের সামনে বসে সেইরকমের ঘোরাঘুরি হতো, তখন থেকেই আমি ভ্রমণ পাগল। মনের মধ্যে “মোটরবাইক” জিনিসটা গেঁথে গেলো।

বার্ষিক পরীক্ষায় ক্লাসের প্রথম হয়ে ক্লাস টু তে উত্তীর্ণ হলাম, আর শীতের ছুটিতে গ্রামে এলাম। চাচা জিজ্ঞেস করলেন এই রেজাল্টের বিনিময়ে তার কাছে আমি কী চাই। আমি একটুও চিন্তাভাবনা না করে উত্তর দিলাম আমার এখন কিছু চাই না তবে যখন আমি নাগাল পাওয়ার মতো বড় হবো তখন আমার একটা মোটরবাইক চাই, প্রত্যেক বছরই সেরা দশের মধ্যে থেকে নতুন ক্লাসে উঠতাম আর গ্রামে গেলে চাচার একই প্রশ্ন আর আমার একই উত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটতো।
তিন-চার বছর পর থেকে চাচা বিষয়টা আস্তে আস্তে ভুলে গেলেন, আর আমি মোটরবাইকের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বড় হতে লাগলাম। পেপারে কোন মোটরবাইকের ছবি দিলে সেটা কেটে আমার ডায়েরীতে লাগাতাম। মোটরবাইকের স্টিকার কিনে ডায়েরীতে লাগিয়ে রাখতাম। এভাবেই একসময় মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এসে কলেজে উঠলাম কিন্তু তখনো আমার ভালোভাবে সাইকেল চালানো শেখারই সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তখন আবার এক চাচাতো ভাই কিনলো Discover 135, গ্রামে গেলে সবসময় সেটায় করে ঘুরতে যেতে উন্মুখ ছিলাম, আর ছিলাম গতির পাগল। বাইকে চড়লে ভাইয়াকে গতি উঠানোর জন্য তাড়া দিতাম।
ভর্তি কোচিংয়ের সময় একটা রেঞ্জার ম্যাক্স কিনে পুরোদস্তুর সাইকেল চালানো শিখে নিলাম। যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিল উদ্ভাসে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করতাম। সাইকেল চালাতে হেব্বি ফিল আসতো আর ভাবতাম না জানি মোটরসাইকেল চালাতে কতো মজা হবে, সাইকেল চালানোর সময় কল্পনায় মোটরবাইক চালানোর কল্পনা করতাম আর বাস্তবে সাইকেলের ডান হাতের গ্রিপকে মোটরবাইকের থ্রটলের মত মোচড়াতে মোচড়াতে অল্পদিনেই গ্রিপ বাতিল করে দিছিলাম। আর মুখ দিয়ে এতো বেশি ভ্রুম ভ্রুম আওয়াজ করতাম যে অল্পতেই আমার গলা শুকিয়ে যেত যাই হোক, Ranger Max টাগ বিক্রি করে একটা মাউন্টেইন বাইসাইকেল কিনলাম।
সে সময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢাকা থেকে ফরিদপুর চলে আসলাম, হলের সিটে শুধু রাতে ঘুমাতাম; আর সারাদিন রুমে থাকতাম না। পুরো শহর জুড়ে উরাধুরা গতিতে বাইসাইকেল চালাতাম, গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর শহর থেকে দশ কিলো দূরে ছিলো। মাঝেসাঝেই যেতাম। এর মধ্যেই একবার সুযোগ হলো মেজো চাচার সেই লিজেন্ডারি বাইকটা নেওয়ার। সমবয়সী চাচাতো ভাই পিছনে বসে ইন্সট্রাকশন দিলো আর আমি বিশ মিনিট পরেই মাঠ থেকে নেমে এলাম পাকা রাস্তায়। প্রথম শিখেই নির্বিঘ্নে ১৫-২০ কিমি মোটরবাইক চালালাম। এর পর আরেকদিন Discover টা নেওয়ার ধান্দা করলাম। আর সুযোগ এসে গেলো, কিন্তু প্রথম শেখার সময় যতটা বিপাকে পরতে হয়নি এবার তার চাইতে অনেক কঠিন হলো। ক্লাচ আর থ্রটলের কম্বিনেশন হচ্ছিলো না আর বারবার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। কিছুটা বশে এনে চালালাম আর এইটা যে আগেরটার তুলনায় আরো অনেক পাওয়ারফুল বাইক, স্মুথ শিফটিং আর পিকআপ তা ভালোভাবে ফিল করলাম।
তার কিছুদিন পরে সেজো কাকা একটা মোটরবাইক কিনলেন আর চাচাতো ভাই আর আমি দুজনে মিলে সেটা অনেক অনেক চালালাম। মোটরবাইক দেওয়ার ব্যাপারে সেজো চাচা ছিলেন অমায়িক। চাচাতো ভাই আর আমার একসাথে সেই বাইক দিয়ে চালানোটা ভালোভাবে রপ্ত হলো। এর মধ্যে একদিন একটা টেম্পোর সাথে হালকা একটা ঘষা খাওয়া ছাড়া কোনরকম দুর্ঘটনায় পরি নাই। আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে অভাব না থাকলেও ছেলেকে মোটরবাইক কিনে দেওয়ার মতো আর্থিক সংগতি ছিলো না। ছেলেবেলায় মোটরবাইক কিনে দেওয়ার ওয়াদা করা চাচাও নিজের ওয়াদা ভুলে গেছেন আর এখন নিজে গিয়েও চাওয়া যায় না। তাই চালানো শিখলেও মোটরবাইক কেনার স্বপ্ন পূরণের উপায় হচ্ছিলো না।

জীবনে কখনো কোন কিছুতে ছ্যাঁচড়ামো করিনি কিন্তু এই মোটরবাইকের বিষয়টায় লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে চাচা, খালু, ভাই, বন্ধুদের নিকট চালাতে চাইতাম। একবার চাইতে যাওয়ার আগে মনের ভেতর যে কী যুদ্ধ চলতো সেইটা কখনো কেউ বুঝতো না।
যাই হোক, আস্তে আস্তে প্রায় কমন সব মডেলের বাইক চালানো হতে লাগলো। ভালো খারাপ বুঝতে শিখছিলাম, বাইকের পার্টস সম্পর্কে জানতে লাগলাম। ভার্সিটি জীবনের প্রথমদিকে টিউশনি শুরু করেছিলাম। টিউশনির টাকায় নিজের খরচ চালাতাম আর বাসা থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিছুদিন পর টার্গেট নিলাম লাখখানেক টাকা জমাবো আর নিজের টাকা দিয়েই একটা ভাঙারি টাইপের পালসার বা CBZ কিনবো।
কিভাবে একজন ভালো গৃহশিক্ষক হওয়া যায় কিভাবে আরো বেশি ছাত্রছাত্রী পড়ানো যায় সেগুলো নিয়ে ছক কাটলাম আর টিউশনি বাড়ানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালালাম।

অদম্য স্পৃহা, পরিশ্রম আর তীব্র আকাঙ্ক্ষা মিলে অধরাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে। বেশ কিছু টিউশনি মিললো আর মোটামুটি ভালো আয় করতে লাগলাম। পরিচিত অনেকে আমাকে “কিপটা” আখ্যায়িত করতো। আমিও মেনে নিতাম আসলেই আমি কিপটা। শুনলে অনেকে হাসবেন ২০টাকাও অকারণে ভাঙতে আমার ইতস্তত বোধ হতো আর মনে হতো টাকাটা জমাই। তিন থেকে চার হাজার টাকায় পুরা মাসের খরচ চালায় নিয়ে বাকি টাকা জমাতাম। কারণ টার্গেট ফিলাপ হতে যে আরো বহু দেরী, প্রাইভেট টিউটর হিসেবে তারপর আরো ভালো সাড়া পেলাম। পুরোদমে টিউশনি চলতেছিলো।
ফেসবুকে দেশের সকল মোটরবাইক কমিউনিটি গ্রুপগুলো ফলো করতাম। যেকোন মডেলের বাইকের কমন সমস্যা বলে দেওয়া আমার জন্য কোন ব্যাপারই ছিলো না। ইউটিউবে সারাদিন বাইকের ভিডিও দেখতাম। এক বছরের মাথায় প্রায় আশি হাজার টাকা জমিয়ে ফেললাম। আর তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক কিনবো না। আরো কিছুদিন দেরি করে আরো বেশি টাকা জমিয়ে নতুন বাইকই কিনবো। আর আয়ের পরিমাণ ভালো হওয়ায় আস্তে আস্তে পাগলামি বাদ দিলাম। বন্ধুদের সাথে বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়া বা ট্যুরে যাওয়ার মতো বড় খরচের বিষয়গুলোতেও এটেন্ড করছিলাম। বেশ ভালোই দিন কাটছিলো। আমি সবসময়ই ঘুরতে পছন্দ করি। দুই/তিন মাসে অন্তত একবার দূরে কোথাও ট্যুরে যাওয়া তো হতোই এছাড়াও সাইক্লিং গ্রুপের সাথে প্রতি শুক্রবার ফ্রাইডে রাইড দিতাম। সাইকেলে করে পুরো ফরিদপুর জেলার সব আনাচেকানাচে ঘুরেছি।
দিনকে দিন বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে শিখলাম আর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলাম যার ফলে স্বপ্নের সাথে বাস করলেও মোটরবাইক কেনার সময়টা পিছিয়ে দিচ্ছিলাম।
এর মধ্যে এক মামা কিনলেন Yamaha Fz fi V2, তখনো মোটরবাইকটা অফিশিয়ালভাবে দেশে আসেনি। এটা চালানোর পর বুঝলাম যে নাহ এইটা আমার কাছে যে সেরা মডেলগুলো (পালসার, হাঙ্ক) তার থেকেও এক ধাপ উপরে। আর তার কিছুদিন পর একদিন চালালাম এক বড় ভাইয়ের জিক্সার।
সে দিনটা বোধহয় আমার মোটরবাইক চালানো জীবনের সেরা দিন কারণ চালিয়ে মনে হচ্ছিলো এতোদিনে এক্কেবারে মনের মতো একটা মোটরবাইক চালালাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম টাকা জমাতে জমাতে যদি বুড়োও হয়ে যাই তবুও আমি জিক্সারই কিনবো। আরেকদিন আরেক চাচার নতুন জিক্সার নিয়ে পিলিয়ন সহকারে ১১১ উঠালাম। আমি তো আনন্দে গদগদ। এতোদিন যত বাইক চালাইছি তাতে গতি একশো উঠাটাই অনেক কিছু ছিলো আর এই মডেলটার দেখি আরো জোর আছে।

নতুন টার্গেট নিলাম ২০১৯ এর জুলাই। ততদিনে দুই লাখ টাকার মতো জমবে আর বাজারে জিক্সারের Fi+ABS ভার্সনটা আসবে আর দেশে বড় বড় কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে মোটরবাইকের দাম কমে আসবে। পুরোই অস্থির একটা প্ল্যান।সময় এগিয়ে যায়। তবুও মাঝেসাঝে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। শুক্রবারের অলস অবসর বিকেলে সাইকেল না নিয়ে মোটরবাইকে দূরে ট্যুর দিতে ইচ্ছে করে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। আর অপেক্ষা করতে না পেরে একবার পরিচিত লোকদের দিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড জিক্সারের খোঁজ লাগালাম। কিন্তু মনমতো মিলছিলো না।

এদিকে দেশে ১৬৫ সিসি অনুমোদন দেওয়ায় নতুন যে বাইকগুলো দেশে আসার অপেক্ষায় আছে সেগুলো দেখলাম। একে একে দেশে আসলো NS ও Hornet, যদিও তখনো কারোটা চালানোর সুযোগ হয়নি তবুও স্পেসিফিকেশন আর রিভিউ দেখে মনে মনে জিক্সারকেই এগিয়ে রাখলাম। তারপর KPR 165 efi বাজারে আসার ঘোষণা হলো। এর স্পেসিফিকেশন, রিভিউ যত দেখলাম তত এটার প্রেমে পড়তে লাগলাম। অপেক্ষা আর অপেক্ষার পালা চলছিলো। আরেকদিন চোখে পড়লো অন্য একটা মডেল যেটা TVS Apache 4v, মোটরবাইকটার লুক বিশেষ করে হেডলাইট আর মিটারের ডিজাইন দেখে আমি পুরাই ফিদা!
তিনটা বাইক নিয়ে কনফিউশন সৃষ্টি হলো। এক বন্ধুর KPR 150 একদিন চালিয়ে KPR কে লিস্ট থেকে বাদ দিলাম। ইউটিউবে সারাদিন Gixxer vs 4v এর ভিডিও দেখি। Gixxer Club Bangladesh গ্রুপে তো আগে থেকেই এড আছি আর ফোরভি তখনও দেশে আসেনি। TVS Bangladesh যেদিন ফোরভি লঞ্চ করলো লঞ্চিং প্রোগ্রামটা দেখলাম। ফোরভি ইউজার একটা দুইটা করে বাড়লো। ফেসবুক গ্রুপ তৈরি হলো আর ইউটিউবাররা ফার্স্ট এক্সপ্রেশন রিভিউ দিলো। তারপর একসময় ফুল রাইড রিভিউ দিলো। আমি তখনো না চালিয়েই ফোরভির দিকে কিছুটা ঝুকে পড়ছি।

বেশ কিছুদিন পর এক জুনিয়রের বড় ভাইয়ের ফোরভি চালানোর সুযোগ হলো। আর সেদিনটাও আমার মনে গেঁথে থাকবে কারণ আমি আমার জীবনে এর চাইতে স্মুথ, পাওয়ারফুল, গর্জিয়াস লুকের কোন মোটরবাইক চালাইনি। সবদিক দিয়েই জিক্সারের চাইতে ভালো ফিডব্যাক পেলাম আর নতুন সিদ্ধান্ত নিলাম ফোরভি নিবো এটাই ফিক্সড। মাঝখানে NS আর Hornet চালিয়ে দেখলেও ফোরভি চালানোর মজাটা জিক্সার ছাড়া আর কোন মোটরবাইকে পাইলাম না। সে সময় নতুন এসেও ইভ্যালি বেশ ভালো নাম কামাচ্ছিলো। ‘১৯ এর নভেম্বরে এনিভার্সারি গিফট কার্ড ছাড়লে মনে করলাম এই সুযোগ। গিফট কার্ড কিনে নতুন মোটরবাইক কেনার ব্যালেন্স বানালাম। তারপর আর কী! একদিন হুট করে অর্ডার দিয়ে বসলাম আর তার বিশ দিনের মাথায় হাতে পেয়ে গেলাম স্বপ্নের মোটরবাইক খানা!

মোটরবাইক কেনার পিছনে যেই আবেগ, তিলে তিলে টাকা জমানো, অমানুষের মতো খাটনি, ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরিচয় সবকিছুর ফল পেয়েছি আসলে।পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের এই আনন্দ কখনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

লিখেছেন- সালমান রহমান পিয়াল

Related Posts

error: Content is protected !!