পালসার কেন দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে? (কেস স্টাডি)

একটা সময় ছিল যখন তরুণ প্রজন্মের খুব জনপ্রিয় একটি বাইক ছিল বাজাজ পালসার ১৫০। ২০০১ সালে বাজাজ প্রথম তাদের এই পালসার ১৫০ সিসি’র বাইকটি বাজারে নিয়ে আসে। মূলত, সেই সময় তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করেই তারা এই বাইকটি লঞ্চ করে। তৎকালীন সময়ে কমিউটার বাইকের ভিড়ে বাজাজ পালসারের এগ্রিসিফ লুক, মাসকুলার বডি ডাইমেনশন, স্পোর্টি রাইডিং পজিশন, ব্রেকিং এবং স্পিডের কারণে বেশ সাড়া ফেলেছিল। ইন্ডিয়া সহ দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বের বেশ কয়টি  দেশে বাইকটি জনপ্রিয়তা পায়।

বাংলাদেশে এই বাইকটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণগুলো হলোঃ

১) সেই সময়ে কমিউটার ও স্পোর্টস কম্বিনেশনের বেশ মাসকুলার একটি বাইক ছিল এটি।

২) তৎকালীন সময়ে ১৫০ সিসি সেগমেন্টে কম্পিটিশন কম ছিল।

৩) এই বাইকের দামও ছিল হাতের নাগালে।

৪) ইঞ্জিন পাওয়ারের দিক থেকেও বাইকটি ছিল বেশ এগিয়ে।

এরপর থেকেই ১৫০ সিসি সেগমেন্টে মার্কেট লিডার হিসেবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় এই বাজাজ পালসার। এর পরে অবশ্য বাজাজ মার্কেটে আরো ১৫০-১৬০ সিসি’র বাইক লঞ্চ করে, যদিও তাদের একটিও পালসারের মত একচেটিয়া জনপ্রিয়তা পায়নি। যেগুলো হচ্ছে পালসার এএস, পালসার এনএস, পালসার নিয়ন, বাজাজ ভি১৫, বাজাজ এভেঞ্জার, ডিসকাভার ১৫০ ইত্যাদি।

১৫০ সিসি সেগমেন্টে নিজেদের আধিপত্য হারানোর সাথে সাথে বাংলাদেশে বাজাজ প্রতি বছর হারাচ্ছে টোটাল মার্কেট শেয়ার। এমনকি আগামী ২-১ বছরের মধ্যে মার্কেট লিডার হিসেবে তারা টিকে থাকতে পারবে কিনা সেটি’র আশংকাও দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কোন ব্রান্ডের মোটরসাইকেলের মার্কেট শেয়ার কত?

আসুন বাজাজের এই আইকনিক বাইক পালসার ১৫০ কেন বাংলাদেশে লিডারশিপ হারালো সেটিই অনুসন্ধান করি।

পালসার বাংলাদেশে দিনকে দিন জনপ্রিয়তা হারানোর কারণঃ

১) চাহিদার পরিবর্তনঃ বর্তমানে যেহেতু ১৫০-১৬৫ সিসি সেগমেন্টের বাইকগুলোর চাহিদা রয়েছে তুঙ্গে, তাই গ্রাহকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রতিটা কোম্পানি তাদের বাইক গুলোতে যোগ করছে নিত্য নতুন ফিচার ও এডভান্স টেকনোলজি, সেই সাথে আপডেট করছে তাদের বাইকগুলোর লুকস। অন্যদিকে, বাজাজ তাদের আইকনিক মডেল পালসার বাইকটিতে ফিচার আপডেটের প্রতিযোগিতায় বেশ পিছিয়ে পড়েছিল। এছাড়াও তারা বিভিন্ন সময় গ্রাফিক্সের পরিবর্তন আনলেও এখন পর্যন্ত বাইকটির একই লুকস ধরে রেখেছে। একটা সময় যে লুকসের দাপটেই পালসার হয়েছিল তরুণদের ক্রাশ আজ সেই একই লুক্সের কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে এই বাইকটি। তেমন কোন নতুনত্ব না থাকায়, অনেকেই শুধু লুকস পরিবর্তনের জন্যই অন্য ব্র্যান্ডের বাইকগুলোতে শিফট হচ্ছে।

২) প্রযুক্তিগত ঘাটতিঃ একটা সময় ছিল যখন শুধু হায়ার সিসি’র বাইক গুলোতেই উন্নত টেকনোলজির ব্যবহার দেখা যেত কিন্তু এখন বিশেষ করে জাপানিজ ব্র্যান্ডগুলো তাদের ১৫০-১৬৫ সিসি বাইককেও নিত্যনতুন টেকনোলজি ব্যবহার করছে। যেমনঃ ফুয়েল ইনজেকশন, ট্র্যাকশন কন্ট্রোল, রাইডিং মোড, এলইডি হেড প্যানেল ইত্যাদি। আর ইন্ডিয়ান ব্রান্ডগুলো টেকনোলজির দিকে থেকে জাপানিজ ব্র্যান্ডের থেকে সব সময় কিছুটা পিছিয়ে থাকে। সেই দৌড়ে পালসার আরো একটু বেশি পিছিয়ে পড়েছে।

৩) পাওয়ার এবং ব্যালেন্সের ঘাটতিঃ প্রতিটা কোম্পানি তাদের এই সেগমেন্টের বাইকে পাওয়ার, কন্ট্রোলিং ও ব্যালেন্স বৃদ্ধি করেছে। অন্যান্য বাইকগুলোর তুলনায় পালসারে ইঞ্জিন পাওয়ার একটু কম, যার ইফেক্ট গিয়ে পড়ে ইনস্ট্যান্ট থ্রটল, টপ স্পিড গেইন ও অফরোডিং এর ক্ষেত্রে। এছাড়াও কন্ট্রোলিং ও ব্যালেন্স এর ক্ষেত্রে জাপানি বাইকগুলো ইন্ডিয়ান বাইকের তুলনায় একটু এগিয়ে।

৪) দাম ও মানের তারতম্যঃ অন্যান্য বাইকগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে ইতিমধ্যেই বেড়েছে পালসারের দাম। কিন্তু সেই তুলনায় বাইকটির মানের দিক থেকে খুব একটা উন্নতি সাধন হয়নি। পালসার ব্যবহারকারী এবং পালসার লাভারদের মতে “আগের পালসার বাইকগুলো ছিল বেশ শক্তপক্ত এবং ভরসাযোগ্য, কিন্তু বর্তমানে যে বাইক গুলো পাওয়া যায় সেগুলো আগের মত শক্ত পোক্ত নেই। মূল্যসাশ্রয়ী করতে গিয়ে পালসার বাইকগুলো তাদের মান অনুন্নত করে ফেলছে।” বিশেষ করে UG-4 এর পরের মডেলগুলোর বিল্ড কোয়ালিটি নিয়ে পালসার লাভাররা একদমই সন্তুষ্ট নয়। বাইকগুলোর লংজিভিটি নিয়েও কাস্টমাররা খুব একটা খুশি না।

৫) কম্পিটিটিভ মার্কেটঃ বাজাজ যখন তাদের পালসার মডেলটি বাজারে লঞ্চ করে তখনকার সময় মার্কেট সিনারিও এবং কম্পিটিশনে পালসার এগিয়ে ছিল। কিন্তু ১৫০-১৬০ সিসি সেগমেন্টে কাস্টমার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য বাইক কোম্পানি গুলো এই সেগমেন্টে আরো ভালো কিছু নিয়ে আসে এবং যেগুলোর দাম পালসার ১৫০’এর আশেপাশেই। বিশেষ করে জাপানি ব্র্যান্ড গুলো বাজারে একের পর এক চমক দেখাতে থাকে। নিচে ছকের মাধ্যমে পালসার ১৫০’এর প্রায় সমমূল্যের (এপ্রিল, ২০২৪) বাইকগুলো তালিকা তুলে ধরা হলো।

৬) যুগোপযোগী মার্কেটিং এর অভাবঃ কথায় আছে “প্রচারেই প্রসার”। কিন্তু এই প্রচারের মাধ্যম দিনকে দিন আপডেট হচ্ছে। যেকোনো কিছুর সাম্প্রতিক খবর জানতে বা বিনোদনের জন্য বর্তমানে মানুষজন অনলাইন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি ঝুঁকেছে। প্রচার মাধ্যমের এই বিবর্তনের দৌড়ে বিভিন্ন মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের ডিজিটাল মার্কেটিং টিম নিয়ে বেশ একটিভ। সেই জায়গাতে বাজাজের দিক থেকে একটা কমতি লক্ষ্য করা যায়। একটি জেনারেশনের কাছে পালসার পরিচিত হলেও পরবর্তী বা নতুন জেনারেশনের কাছে পালসার বাইকটির গ্রহণযোগ্যতা যাতে বাড়ে, সেই অনুযায়ী আরো অনলাইন প্রমোশন প্রয়োজন।

মূলত, একটা সময় মার্কেটে প্রতিযোগিতা কম থাকায় এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে পালসারের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। সেই সাথে সময়ের সাথে সাথে লুকস-এ তেমন পরিবর্তন এবং টেকনোলজিক্যালি এডভান্সড না হওয়ার কারনেই এই পরিণতি।

যদিও পালসার ১৫০-তে কয়েক বছর আগে ডাবল ডিস্ক এবং এবিএস এড করা হয় কিন্তু লুকস-এর পরিবর্তন চোখে পড়ার মত নয়। তবে এখানে বাজাজের চিন্তা ধারাটা হয়তো ভিন্ন। তারা হয়তো পালসার ১৫০-কে বাজেট ফ্রেন্ডলি রাখার জন্যই খুব একটা আপগ্রেড করছে না। সেই সাথে ১৫০-১৬০ সিসি সেগমেন্টে তারা পালসার এন১৬০-তে ফোকাস দিচ্ছে। তবে যদি পালসার এএস এবং এনএস-এর মত এন১৬০ মার্কেটে জনপ্রিয়তা তৈরী করতে না পারে, তাহলে ১৫০ সিসি সেগমেন্ট এবং বাংলাদেশে বাজাজের পুরো মার্কেট শেয়ারের উপর একটা বিরাট প্রভাব পড়বে।

যদিও একটা সময় বাংলাদেশে বাজাজের মার্কেট শেয়ার ছিল ৪০% এরও বেশি কিন্তু গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৭% এ। শুধু তাই নয়, দেশীবাইকার টিমের সংগ্রহীত তথ্য মতে চলতি ২০২৪ সালে বাজাজের টোটাল সেলকে প্রায় ধরে ফেলেছে সুজুকি। মূলত ১৫০-১৬০ সিসি সেগমেন্টের মার্কেট বাংলাদেশে বড় হতে থাকায়, শুধুমাত্র সুজুকি জিক্সারের চাহিদার কারণেই বাজাজের মার্কেট শেয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছে এই জাপানীজ ব্রান্ডটি।

২০২২-২৩ অর্থ বছরে সর্বমোট ৪৭৯,৭২১ টি বাইক বিক্রি হয়, যার মধ্যে ১৫০-১৬৫ সিসি’র বাইক ছিল প্রায় ২২২,৬০৪ টি (৪৬.৪%)। গত অর্থবছরে ১৫০-১৬৫ সিসি সেগমেন্টে সর্বোচ্চ বাইক সেল করে ইয়ামাহা (২৯.৫%) এবং সুজুকি (২৬.২%)। এরপরেই রয়েছে বাজাজ (২০.৫%), টিভিএস (১০.৮%), হিরো (২.৩%), রানার (০.৮%) এবং অন্যান্য বান্ড (১.৬৬%)। এই তথ্য উপাত্ত বিবেচনা করলে অনুমান করা যায়, ১৫০-১৬৫ সিসি সেগমেন্টে ভাল করতে না পরলে খুব শীঘ্রই বাজাজ বাংলাদেশে মার্কেট লিডারশীপ হারাবে।

যদি জানতে চান, বাংলাদেশে পালসার ১৫০-এর মার্কেট নিয়ে নিলো কোন বাইকগুলো? উত্তরে সবার আগে আসবে সুজুকি জিক্সার মনোটোন। এছাড়াও ইয়ামাহা এফজেডএস ভি২, আরটিআর ৪ভি এবং হোন্ডা এক্সব্লেড পালসারের জায়গা স্থানান্তরিত হচ্ছে।

যেহেতু বাংলাদেশে সিসি লিমিট ৩৭৫ সিসি পর্যন্ত উত্তীর্ণ করা হয়েছে, তাই আগামীতে ক্রেতাদের চাহিদা আরো পরিবর্তন হতে পারে। তবে ১৫০-১৮০ সিসি সেগমেন্টে যারা ভাল করবে, তারা টোটাল মার্কেট শেয়ারের উপর আগামী দিনগুলোতে প্রধান্য বিস্তার করবে বলে ধারণা করা যায়।

অলি আহাদ খান

Related Posts

Add Comment

রিপ্লে দিন

error: Content is protected !!