হেলমেটের সকল খুঁটিনাটি (পর্ব ১ – কেনার আগে জানুন)

MT helmets Bangladeshবর্তমান সময়ে মোটরসাইকেল রাইডিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে মোটরসাইকেলর বাজার বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে এর নানাবিধ ব্যবহার। কেউ ব্যবহার করেন অফিস এবং দৈনন্দিন কাজের জন্য আবার কেউবা এডভেঞ্চার ট্যুরের জন্য। এছাড়া বাংলাদেশে উবার এবং পাঠাও এর মত রাইডিং সেবা চালু হওয়ার পর থেকে অনেকের কাছে মোটরসাইকেল এখন জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস। কিন্তু মোটরসাইকেলের রাইডিং সেফটি নিয়ে আমরা কতটা সচেতন?

মোটরসাইকেলে রাইডিং সেফটি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে সেফটি কিটটির কথা আপনার মাথায় আসবে সেটি হল হেলমেট। বিশ্ব অর্থনৈতিক সমীক্ষা মতে, বিশ্বে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ৮০ শতাংশই হেলমেট পরিধান করে না। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সবথেকে বড় কারনটি হল মাথায় বা মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া। তাই একটি সঠিক এবং গুনগত মান সম্পন্ন হেলমেট ব্যবহার না করা আপনার জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ।

হেলমেট কেনার পূর্বে অনেকেরই মনে প্রশ্ন থাকে, কোন ব্রান্ডের হেলমেট কিনবেন, কত সাইজের হেলমেট কিনবেন, হেলমেটে কি কি সার্টিফিকেশন থাকা প্রয়োজন ইত্যাদি। একটি সঠিক এবং ভাল মানের হেলমেট যেমন যে কোন রাইডিং কন্ডিশনে আপনাকে কার্যকর সেফটি প্রদান করবে, ঠিক তেমনি হেলমেট নির্বাচনে ভুল করলে ১০ মিনিটের রাইডও আপনার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে। তাই আজ আমরা আলোচনা করব একটি সঠিক হেলমেট বাছাইয়ের জন্য কোন কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।

সঠিক মাপ এবং আকারঃ 

অনেকেই নিজের টি-শার্টের সঠিক সাইজ জানলেও হেলমেটের সাইজ সম্পর্কে তেমন কোন ধারনাই নেই।প্রত্যেক ব্যক্তিরই পৃথক ব্যক্তিত্ব এবং শরীরিক গঠন আলাদা থাকে। মানুষের মাথার সাইজও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। মানুষের মাথার সাইজকে মূলত ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হচ্ছে, রাউন্ড অভাল, ইন্টারমেডিয়েট অভাল এবং লং অভাল। তাই একজন রাইডারের হেলমেট অন্য একজন পড়লে সঠিকভাবে এডজাস্ট হয় না। যদি একটি হেলমেট পড়ার পর আপনার মনে হয় মাথার বিভিন্ন পয়েন্টে চাপ অনুভব করছেন তাহলে হেলমেটটি আপনার সাইজের নয়। কেননা প্রত্যেকটি হেলমেট প্রস্তুত করা হয় মাথার বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত সেফটি প্রদানের জন্য। একটি সঠিক মাপের হেলমেট আপনার ভালভাবে ফিট হবে, নড়াচড়া করবে না এবং আপনার মুখের চোয়ালের সাথে ভালভাবে আটকে থাকবে। 

ডিজাইন এবং বাইরের শেলঃ

হেলমেট কেনার সময় সর্বপ্রথম বাইকাররা যে বিষয়টি খেয়াল করেন সেটি হচ্ছে ডিজাইন। বেশিরভাগ সময়ই বাইকাররা তাদের বাইকের ডিজাইন, কালার এবং গ্রাফিক্সের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই হেলমেট ক্রয় করে থাকেন। শুধু তাই নয়, একটি ভাল ডিজাইনের হেলমেট আপনার রাইডিং কিটের সৌন্দর্য্য বহুগুণে বৃদ্ধি করে। তবে শুধুমাত্র ডিজাইনই সবকিছু নয়, হেলমেটের বাইরের শেলটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ন। কেননা যেকোন দূর্ঘটনার সময় বাইরের শেলটি আপনাকে সেফটি প্রদান করে। তাই বাইরের শেলটি মজবুত এবং ভালমানের উপাদান দিয়ে তৈরী করা হয়েছে কিনা সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। যে সকল হেলমেটের শেল পলি-কার্বোনেট উপাদান দিয়ে তৈরী করা হয় সেগুলো অনেক হালকা এবং একই সাথে মজবুত হয়ে থাকে।পলি-কার্বোনেট যেকোন দূর্ঘটনার আঘাত শোষন করে নিতে পারে এবং সহজে ভেঙ্গে যায় না।

প্যাডিংঃ 

হেলমেট ব্যবহার করা হয় যে কোন আঘাত কিংবা দূর্ঘটনার হাত থেকে আপনার চোয়াল এবং মাথা রক্ষা করার জন্য। সেজন্য হেলমেটের প্যাডিং অনেক গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে। হেলমেটের প্যাডিং আপনার চোয়াল এবং মাথার সাথে ভাল ভাবে চেপে আছে কিনা সেটি খেয়াল করুন। কেননা, প্যাডিং যদি আলগা থাকে তাহলে দূর্ঘটনার সময় সেটি মাথা থেকে বেড়িয়ে আসবে। এছাড়া প্যাডিংটি খুলে পরিস্কার করা যায় কিনা সেটি দেখে নিন। প্যাডিং যদি অপসারনযোগ্য হয় তাহলে আপনি সেটি প্রয়োজনমত পরিস্কার করে নিতে পারবেন। বিশেষ করে যারা এলার্জিক তাদের জন্য এটি অনেক কার্যকর।

ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাঃ

সাধারনত ফুল-ফেস হেলমেটের ক্ষেত্রে সঠিক এবং কার্যকর ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা দরকার। একটি হেলমেটে সাধারনত মুখের সামনে, মাথার উপরে এবং মাথার পিছনের দিকে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে। তবে সকল হেলমেটের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা সঠিক থাকে না। বিশেষকরে যারা লং ট্যুর করেন এবং দীর্ঘক্ষন বাইক রাইড করেন তাদের হেলমেটের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা অবশ্যই ভাল থাকা উচিৎ। হেলমেটে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল না করলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ভাইসরঃ

হেলমেটের আরও একটি গুরুত্বপুর্ন বস্তু হল ভাইসর। ভাইসরটি অবশ্যই সম্পুর্ন পরিস্কার হতে হবে যেন রাডিংয়ের সময় সামনের বস্তু দেখতে কোন অসুবিধা না হয়। অনেকেই স্টাইলিংয়ের জন্য স্মোকড এবং রঙ্গিন মার্কারি ভাইসর পছন্দ করেন, যার ফলে একজন রাইডার পরিস্কার দেখতে অসুবিধা হয়। তাই অবশ্যই এই ভাইসরগুলো পরিহার করা উচিৎ। এছাড়া আমাদের দেশে বর্ষা এবং শীতকালের প্রাধান্য থাকায়, এই সময়গুলোতে সাধারন ভাইসর দিয়ে দেখতে সমস্যা হয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য এন্টি-ফগ এবং এন্টি-স্ক্রাচ ভাইসর লাগিয়ে নেয়া উচিৎ।

সার্টিফিকেশনঃ

হেলমেট ক্রয়ের পূর্বে অবশ্যই দেখে নিন হেলমেটের গায়ে কোন কোন সার্টিফিকেশন উল্লেখ করা আছে। সার্টিফিকেট বিহীন সাধারন মানের হেলমেট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। বাংলাদেশে যে সকল হেলমেট সার্টিফিকেশন লক্ষ্য করা যায় তাদের মধ্যে DOT, ECE, SNEEL, SHARP এবং FIM সবথেকে বেশি লক্ষ্য করা যায়। সাধারনত DOT এবং ECE সার্টফাইড হেলমেটের ব্যবহার আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি। DOT সার্টিফিকেশন প্রদান করে থাকে Department of Transport যেটি USA এর সড়ক মন্ত্রণালয়। United Nations Economic Commission for Europe (ECE) সার্টিফিকেশন ব্যবহার করা হয় ইউরোভুক্ত দেশগুলোর জন্য। তবে বর্তমান সময়ে ইংল্যান্ড ভিত্তিক সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান SHARP Rating দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কেননা তারা সচরাচর পরিক্ষার বাইরে নিজস্ব নিয়মে বেশ কিছু পরিক্ষা করে থাকে এবং হেলমেটের বিভিন্ন প্রেসার পয়েন্টে হেলমেটটি কতটুকু আঘাত সহ্য করতে সক্ষম এবং কতটুকু নিরাপত্তা প্রদান করবে তা উল্লেখ করে। এছাড়াও SNELL এবং FIM এই দুটি সার্টিফিকেশন মানুষের মাঝে দিনকে দিন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই বাজারে অনেক হেলমেট পাওয়া গেলেও অবশ্যই সার্টিফাইড হেলমেট ক্রয় করুন।

বাজেট এবং বিশ্বস্থতাঃ

হেলমেট কেনার পূর্বেই আপনার বাজেট নির্ধারন করুন। কেননা আপনার বাজেটের উপর নির্ভর করবে আপনার হেলমেটের মান। এছাড়া বাজারের হেলমেটের ব্রান্ডগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। আপনার বাজেটের মধ্যে কোন ব্রান্ডের হেলমেট সবথেকে বেশি সুরক্ষা প্রদান করবে সেটি যাচাই করুন। এছাড়া বাজারে অনেক নকল এবং কপি হেলমেট পাওয়া যায় যা চিনতে সহজেই যে কারই ভুল হতে পারে। তাই অবশ্যই বিশ্বস্থ্য ব্রান্ডের সার্টিফাইড হেলমেট ক্রয় করুন।

যে কোন দেশের আইনেই হেলমেট বাধ্যতামূলক ভাবে ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হল, হেলমেট এমন একটি রাইডিং কিট যেটি আপনার জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে। তাই শুধুমাত্র আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্যই নয়, নিজের জীবনের সুরক্ষার জন্য হেলমেট ব্যবহার করুন।