মোটরসাইকেলের হেলমেট নির্বাচন – যে বিষয়গুলো মনে রাখা জরুরী

স্বাধীনচেতা মানুষ দুই চাকা পছন্দ করে আর এর আনন্দও অন্যরকম।  কিন্তু আপনি যাই চালান না কেন, সেটা কমিউটার বাইক হোক অথবা ক্রুজার বাইক, সবার আগে নিজের সেফটি নিশ্চিত করতে হবে। জরিপে দেখা গেছে দূর্ঘটনার ফলে প্রায় ৭০% মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয় মাথায় ইনজুরির কারণে।

তাই মোটরবাইক চালানোর পূর্বে আপনাকে মোটরসাইকেল এর রাইডিং গিয়ারের পিছনে কিছু টাকা খরচ করতে হবে যাতে আপনি নিরাপদে বাইক চালাতে পারেন।  সর্বপ্রথম যেটার দিকে নজর দিতে হবে তা হলো হেলমেট।  তো আপনি যেমন মোটরবাইক কেনার আগে সেটা সম্পর্কে ভাল মত গবেষণা করে তারপর কিনেছেন, এখন হেলমেট কেনার ক্ষেত্রেও সেরকম ছোটোখাটো একটা গবেষণা করে ফেলতে পারেন।

একটি বিষয় যুক্ত না করলেই নয় সেটি হচ্ছে যে, আমরা বাইক কেনার ব্যাপারে বেশ সচেতন এবং অনেক টাকা খরচ করি কিন্তু যেই হেলমেট আপনার শরীরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে তার ব্যাপারে বেশ গাফেল। হেলমেট দেখতে কেমন, তার থেকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে কতটা শক্তিশালী। বেশিরভাই বাইকাররাই কম খরচের মধ্যে হেলমেট খোঁজেন যেগুলো মোটেই নিরাপদ নয়।

আপনি খেয়াল করে থাকবেন যে স্পোর্টস বাইকের হেলমেট, একটি ডার্ট বাইক অথবা মোটোক্রস বাইক থেকে আলাদা ধরণের হয়ে থাকে।  স্পোর্টস বাইক অথবা ক্রুজার বাইকের হেলমেট কিছুটা গোল ধরনের হয়ে থাকে এবং এটাতে ডার্ট বাইকের হেলমেটের মতো সামনের দিকের বাড়তি অংশটা থাকে না যেটা থুতনি এর নিরাপত্তার জন্য লাগানো থাকে। যাই হোক, আপনার বিভিন্ন ধরণের হেলমেট পছন্দ করে কেনার স্বাধীনতা আছে কারণ,  বাজারে বিভিন্ন ধরণের হেলমেট পাওয়া যায়। যেমন:

১. ফুল ফেস হেলমেট।

২. ডুয়াল স্পোর্ট।

৩. হাফ শেল।

৪. মডুলার।

৫. ওপেন ফেস।

আশা করি এই মোটরসাইকেল হেলমেট কেনার উপদেশমালা বিষয়ক পোস্টটি আপনাকে আপনার দরকার মতো হেলমেট কিনতে ব্যাপক সহায়তা করবে। এই পোস্টটি পড়লে আপনি যা যা জানতে পারবেন তা হলো:

১. হেলমেট কেন ব্যবহার করবেন

২. হেলমেটে আপনি কি কি বৈশিষ্ট্য চান

৩. নিরাপত্তা রেটিংস

৪. কি ধরণের বাইক আপনি চালান

৫. হেলমেটের আয়তন এবং মাথার আকৃতি

৬. হেলমেটের দাম

 

হেলমেট কেন ব্যবহার করবেন?

১. আপনি কি একজন শিক্ষানবিস?

আপনি যদি একজন শিক্ষানবিস হন তাহলে আপনি যেই বাইকই চালান না কেন, আপনার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত দামি হেলমেট কেনার দরকার নেই।  দামি হেলমেট পড়ার থেকে প্রথমত আপনাকে মোটরসাইকেল ঠিক ভাবে এবং দক্ষ হাতে চালানোর দিকে জোর দিতে হবে।  তবে যে হেলমেটই কিনুন না কেন, সেটি যাতে আপনার মাথার নিরাপত্তা দিতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

২. আপনি কি প্রচুর বাইক রাইডিং করতে চান নাকি শুধু নিত্য দিনের কাজের জন্য বাইক ব্যবহার করতে চান ?

আপনি যদি প্রতিদিনই বাইক ব্যবহার করে থাকেন অথবা প্রতি সপ্তাহে ব্যবহার করেন তবে আপনার জন্য হাই এন্ড হেলমেট বেশি ভালো হবে।  কারণ এটা পড়তে আপনি সাচ্ছন্দ বোধ করবেন এবং এটা আপনাকে গতির সাথে স্বচ্ছন্দ রাখবে আর বাতাসের শব্দ কম করবে।

৩. আপনি কি একটি দলের সাথে যাত্রা করছেন?

অনেক বাইকারই  কিন্তু বিভিন্ন বাইকিং দলের সাথে রাইড করে।  তো আপনিও হয়তো বাইক কেনার পরে এরকম কোন রাইডিং দলের সাথে একসাথে রাইড  করতে চাবেন। এক্ষেত্রে আপনাকে এমন হেলমেট কিনতে হবে যাতে হেলমেটের মধ্যেই পূর্বনির্মিত যোগাযোগ করার ব্যবস্থা থাকে, কারণ দলগত রাইডিং এর ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা খুবই জরুরি।  যেমন গ্রুপ রাইডিংয়ের সময় ব্লুটুথ হেডফোন বেশ কার্যকরী।

 

হেলমেটে কি ধরণের বৈশিষ্ট্য চান ?

১. হেলমেটের ওজনঃ

সাধারণত একটি হেলমেটের ওজন ১৪০০ থেকে ১৮০০ গ্রামের মধ্যে হয়।  এক্ষেত্রে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে এমন হেলমেট কেনার জন্য যেটি আপনার মাথায় ভালোভাবে খাপ খায়, ফলে হেলমেটের পুরো ওজন মাথায় সমান ভাবে বন্টন হয়ে যাবে। যদি হেলমেটের ভার কেন্দ্র সামান্য বিচ্যুত অবস্থায় থাকে তবে হেলমেটটি ভারী মনে হতে পারে এবং ঘাড় ব্যাথা শুরু হতে পারে।

২. হেলমেট নির্মাণ উপাদান

হেলমেটটি কি কি উপাদান দিয়ে তৈরী করা হয়েছে সেটা বিভিন্ন ব্যাপারকে প্রভাবিত করে যেমন ওজন, স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তা রেটিংস। বেশির ভাগ হেলমেটই পলিকার্বনেট, ফাইবারগ্লাস কম্পোসিট এবং কার্বন ফাইবার দিয়ে নির্মাণ করা হয়।

৩. ঐচ্ছিক উপাদান

এখনকার হেলমেটগুলো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক উন্নত।  যেমনঃ ইন্টিগ্রেটেড সানশেড, বাতাস কম লাগার ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এগুলোর মধ্যে অন্যতম। এগুলো আপনার মোটরবাইক চালানোর অভিজ্ঞতাকে রোমাঞ্চকর করে তুলবে।

 

হেলমেটের নিরাপত্তা রেটিংস বিবেচনা করুন

১. DOT- আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রান্সপোর্টেশন হেলমেটের নিরাপত্তার জন্য কিছু নিম্নতম মান সেট করে দিয়েছে।

২. ECE22.02- ইউ যেন এর ইকোনোমিক কমিশন ফর ইউরোপ ইউরোপে হেলমেটের নিরাপত্তার জন্য কিছু নিম্নতম মান সেট করে দিয়েছে।

৩. Snell2010- এটি একটি অলাভজনক সংগঠন যা পিট্ স্নেল নামক এক স্পোর্টস কার চালক এর  দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত লেগে মৃত্যুর পর থেকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

 

হেলমেটের আয়তন এবং মাথার আকৃতি

হেলমেটের আয়তন কিভাবে মাপবেনঃ

আপনাকে দুর্ঘটনার সময় নিরাপদ রাখতে একটি হেলমেটের আয়তন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।  হেলমেট কেনার ক্ষেত্রে আপনার মাথার আকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার:

১. আপনার মাথার মাপ নিন। প্রথমে একটি মাপার ফিতা আপনার মাথার চারপাশে পেঁচিয়ে নিন ভ্রু এর একটু উপর থেকে, কানের উপরে এবং মাথার পিছনে সবচেয়ে বড়ো জায়গাটাতে। এই কাজের সময় কারো সাহায্য নিলে সুবিধা হবে।

২. আপনার মাথার মাপের সাথে মিলিয়ে হেলমেট কিনুন। প্রতিটি হেলমেট নির্মাতা কোম্পানি তাদের হেলমেটের সাথে হেলমেটের মাপের একটি হিসাব দিয়ে দেয়।  সেটি দেখে হেলমেট কিনুন।

৩. হেলমেট কেনার আগে পড়ে দেখুন। এটি যদি আপনার মাথায় ঠিক মতো ফিট করে তাহলেই কিনুন নচেৎ নয়। তবে একটা ব্যাপার আপনার জেনে রাখা ভাল যে যেই হেলমেট আপনার মাথার জন্য নিখুঁত সেটা প্রথমে আপনার মাথায় একটু টাইট হবে।  কিন্তু কিছুদিন ব্যবহারের সাথেই এটি মাপে চলে আসবে।

একজনের মাথার মাপের হেলমেট খুব স্বাভাবিক ভাবেই অন্য আরেকজনের মাথায় ঠিক ভাবে ফিট নাও হতে পারে।  কারণ হেলমেটের মাপ মাথার আয়তনের সাথে সাথে আকৃতির পরেও অনেকাংশে নির্ভর করে।

আপনি কি ধরণের বাইক চালান

১. ভ্রমনে যাওয়ার জন্য:

এই ধরণের বাইকের চালকেরা সাধারণত মডুলার হেলমেট পছন্দ করে থাকেন কারণ এই ধরণের হেলমেটে সামনের ফেস শিল্ড উপরে উঠানো যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে পুরো সামনের অংশটাই উপরে তোলা যায়।

২. ক্রুজার বাইক :

ক্রুজার রাইডাররা সাধারণত হাফ শেল হেলমেট পড়তেই বেশি পছন্দ করেন।

৩. ওল্ড স্কুল/ক্যাফে বাইক:

এই ধরণের মোটরবাইক চালকেরা সাধারণত ওপেন ফেইস হেলমেট ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটি যেকোনো হাফ শেল হেলমেটের থেকে বেশি নিরাপত্তা প্রদান করে।

৪. স্পোর্টসবাইক:

ফুল ফেস হেলমেট স্পোর্টসবাইক চালকদের জন্য আদর্শ হেলমেট। এর চারিদিকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে এবং থুতনির সামনে একটি থুতনিরক্ষক আছে এবং একটি উল্টানো শিল্ড থাকে।

সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুলফেস হেলমেটকেই সব থেকে নিরাপদ বলে ধরে নেয়া যায়।

হেলমেটের দাম:

হেলমেটের দাম হলো এমন একটি ব্যাপার যা আপনাকে সবার আগে বিবেচনা করতে হবে এবং আপনি যদি একজন শিক্ষানবিস হন তাহলে তো অবশ্যই হেলমেটের দামটাই আপনার কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। বেশি দাম মানেই কিন্তু বেশি ভাল অথবা বেশি নিরাপদ হেলমেট না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেলমেটে কি কি ফিচার ব্যবহার করা হয়েছে সেটার উপর হেলমেটের দাম নির্ভর করে।

বাংলাদেশের বাজারে একটি মোটামুটি ভাল মানের ফুলফেস হেলমেট কিনতে আপনাকে অবশ্যই অন্ততঃ ৪ হাজার টাকা বাজেট রাখা উচিত। লাখ টাকা দিয়ে বাইক কেনার সামর্থ্য থাকলে, এই টাকা অন্ততঃ আপনার কাছে খুব বেশি হওয়ার কথা না।

 

লিখেছেনঃ দেওয়ান সোহান