রাজধানীতে বাড়ছে মোটরসাইকেল চুরি

রাজধানীতে প্রায়ই মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটছে। কখনও কখনও ভয় দেখিয়ে কিংবা অস্ত্র ঠেকিয়ে করা হচ্ছে মোটরসাইকেল ছিনতাই। প্রাণনাশের ভয়ে কেউ কেউ নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও মিলছে না প্রতিকার। অরক্ষিত পার্কিংয়ের কারণে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। সেই সঙ্গে ব্যবহারকারীদের সচেতনতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির অভাবও এ ধরনের চুরির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

রাজধানীতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল অতি প্রয়োজনীয় একটি বাহন। কিন্তু মোটরসাইকেল চুরির সক্রিয় সদস্যদের দৌরাত্ম্যে খোয়াতে হচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় এ দু’চাকার বাহনটি।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, মিরপুর, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল চুরি চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। ভুক্তভোগীদের তথ্য অনুযায়ী শুধু পুরান ঢাকার আশপাশে রয়েছে প্রায় ১২টি চক্র। একেকটি চক্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য কাজ করে। অভিযোগ রয়েছে, এসব চক্রের সক্রিয় সদস্যদের পেছনে মূল সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। আবার তাদের নেপথ্যে থেকে অস্ত্রের জোগান ও বিভিন্ন সময় জামিনে বের করে আনেন এলাকার এসব প্রভাশালী ব্যক্তি।

ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে এসব সিন্ডিকেটের মূল ব্যক্তিরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবুও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদা তৎপর রয়েছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।

ডিএমপির তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে চলতি বছরের গত তিন মাসে মোটরসাইকেল চুরির মামলা হয়েছে ৫৩টি। পরিসংখ্যান বলছে এ চুরি ক্রমাগত বাড়ছে। জানুয়ারি মাসে চুরির মামলা হয়েছে ৬টি, ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে ১১টি এবং মার্চ মাসে হয়েছে ৩৮টি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফল অভিযানে ৩৩টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

প্যান্ট-কোট আর সু পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠানের সামনে অপেক্ষা করতে থাকে মোটরসাইকেলের জন্য। সময় সুযোগ বুঝে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে অনুসরণ করতে থাকে। ব্যবহারকারীর গতিবিধি অনুযায়ী শুরু করে চুরির কার্যক্রম। প্রথমে ছদ্মবেশে যে এলাকায় চুরি করবে সে এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান জেনে নেয় চক্রের একজন সদস্য। নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য সরবরাহ করতে থাকে সেই সদস্য। অন্যজন মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে অনুসরণ করতে তার পেছনে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। কখনও কখনও এসব তথ্য সরবরাহ করতে ২ থেকে ৫ জন সদস্যও কাজ করে। তারপর তারা মুঠোফোনের মাধ্যমে যে সদস্য মোটরসাইকেলটি চুরি করবে তার সঙ্গে থাকা অন্য সদস্যদের চুরির জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করলেই মুহূর্তের মধ্যে চোরটি উধাও হয়ে যায় মোটরসাইকেল নিয়ে। একটি মোটরসাইকেল চুরি করতে চক্রের সদস্যরা সময় নেয় ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আশপাশের পরিবেশ অনুকূলে থাকলে মূলত মোটরসাইকেলটি চুরি করতে সময় লাগে ১ থেকে সর্বোচ্চ ৩ মিনিট। ঘাড় লক খুলতে নেয় এক মিনিট। তারপর একটি তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আউটপুট-ইনপুট লাগিয়ে বাকি দুই মিনিটে শেষ করে চুরির কার্যক্রম। এভাবেই প্রতিনিয়ত অসংখ্য মোটরসাইকেল চুরি করছে চক্রের সক্রিয় সদস্যরা। যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবন, পূর্ত ভবন, রাজস্ব ভবন, রূপায়ণ টাওয়ার, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অরক্ষিতভাবে মোটরসাইকেল পার্কিং করায় চক্রের সদস্যরা সহজেই চুরি করছে মোটরসাইকেল। এ সময় কেউ কেউ দেখলেও বুঝতে পারেন না যে যিনি মোটরসাইকেলটি নিচ্ছেন তিনি চোর নাকি ব্যবহারকারী। এছাড়া এ চক্রের সদস্যরা সময় সুযোগ বুঝে কখনও কখনও লোকচক্ষুর আড়ালে করছে ছিনতাই। উত্তরা হাউস বিল্ডিং, দিয়াবাড়ী, কুড়িল বিশ্বরোড, দক্ষিণখানসহ বিভিন্ন স্থানে রাতের আঁধারে এবং সকালের প্রথম প্রহরে মাঝপথে দাঁড়িয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় মোটরসাইকেলটি। বাধা কিংবা প্রতিবাদ করতে গেলে চক্রের অন্য সদস্যরা এসে মারধর ও গুলি করে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিতভাবে সড়কের পাশেই পার্কিং করে রাখা হয়েছে শত শত মোটর সাইকেল। এসব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরা বলছেন, সচেতন হয়ে কোনোভাবেই ঠেকানো যায় না এসব চুরি। নির্ধারিত পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে সড়কের পাশেই অরক্ষিতভাবে পার্কিং করছেন মোটরসাইকেল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত একটি ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিভ সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি নিজেও একজন ভুক্তভোগী। চাকরির প্রয়োজনে কয়েক মাস আগে টাকা-পয়সা ধারদেনা করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটি হিরো মোটরসাইকেল কিনেছিলেন। কিন্তু কেনার মাসখানেক পরই অতি প্রয়োজনীয় মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এ বিষয়ে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। এখনও ফিরে পাননি। জানা যায়, চুরি হওয়া এসব মোটরসাইকেল বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভুয়া নাম্বার প্লেট বসিয়ে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করা হয়। মোটরসাইকেলের মডেল অনুযায়ী একেকটি বিক্রি করে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। এরপর এ টাকা চক্রের সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাঝে ভাগ-বণ্টন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোটরসাইকেল চুরি চক্রের একজন সদস্য বলেন, রাস্তার পাশ থেকে চুরি করা একদম সহজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান দেখে চুরি করি। এ সময় যদি কেউ দেখে ফেলে কিংবা বাধা দেয় তাহলে নিজেদের আত্মরক্ষার্থে গুলি করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, এ ধরনের চুরি ঠেকাতে ব্যবহারকারীদের সচেতনতার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের সহযোগিতার কারণে এমন কাজ চক্রের সদস্যদের উৎসাহিত করে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিআরটিএর জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত শাস্তির ব্যবস্থা করা। তাহলে অনেকাংশে এসব চুরি ঠেকানো সহজ হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মোটরসাইকেল চুরিটা সহজ। এটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও সচেতন হতে হবে। দীর্ঘক্ষণ পার্কিংয়ে না রাখা, সুরক্ষিত জায়গায় পার্কিং করা এবং মার্কেট বা এ জাতীয় কোথাও পার্কিং করলে অবশ্যই সিকিউরিটি গার্ডকে অবহিত করার মাধ্যমে এ চুরি রোধ করা সম্ভব। আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সফল অভিযান পরিচালনা করে মোটরসাইকেল উদ্ধার এবং চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

 

সূত্র: যুগান্তর

Related Posts

error: Content is protected !!