মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার কারন এবং প্রতিকার

যত গতি তত ক্ষতি, মোটরসাইকেলের সাথে এই কথাটি যেন একদম মানানসই। সারাবিশ্বে যত দূর্ঘটনায় মানুষ মারা যান তার বেশির ভাগই মোটরসাইকেল আরোহী। তার পরও দুই চাকার এই যানটিকে নিয়ে মানুষের এক্সসাইটমেন্টের কমতি নেই। কিন্তু এই এক্সসাইটমেন্টের পিছনে ছুটতে গিয়ে কিছু অসাবধানতায় হয়ে যেতে পারে মারাত্মক দূর্ঘটনা। মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় যেমন একজন বাইকারের চালানোর ধরন দায়ী ঠিক তেমনি আমাদের দেশের রাস্তা-ঘাটের কন্ডিশন, পথচারী এবং যানবাহনের দায়টাও কম নয়। তবে চলুন জেনে নিই মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার কারন এবং তার প্রতিকার।

প্রথমেই মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার কিছু পরিসংখ্যান জানানোর চেষ্টা করব আপনাদের। সম্প্রতি ইংল্যান্ড তাদের একটি ট্রান্সপোর্ট জরিপে উল্লেখ করে মোট্রসাইকেলে দূর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা গাড়ী দূর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে ১৬ গুন এবং আহত হওয়ার পরিমান ৬২.৫ গুন বেশি। অস্ট্রেলিয়া তাদের রোড ট্রান্সপোর্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার শিকার বেশিরভাগ রাইডারের জন্ম ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যেই অর্থাৎ তরুণ প্রজন্ম। এছাড়া ৪০ কিংবা তার বেশি বয়সী রাইডারদের দূর্ঘটনার হার শতকরা ২০ ভাগ।

এত গেল আন্তর্জাতিক খবর, এখন কথা বলা যাক আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দূর্ঘটনার হার কি রকম। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মোটরসাইকেল মার্কেট প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং এবং সেই সাথে বেড়ে চলেছে দূর্ঘটনাও। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি কিছুদিন আগে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে ২০১৬ সালে মোট মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৮৮ টি এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৩৬টি। ২০২০ সালে যেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০৮ টিতে এবং মৃতের সংখ্যা ১০৯৭ জন।

বাংলাদেশে দূর্ঘটনার হার ক্রমবর্ধ্মানভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারন রয়েছে। তবে চলুন জেনে নেয়া যাক আমাদের দেশে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলো এবং কিভাবে প্রতিকার পাবেন সে সম্পর্কে। 

ওভারস্পিডিংঃ

প্রতিদিন টিভি কিংবা পত্রিকা খুললেই দেখা যায় মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার খবর। এই দূর্ঘটনার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে ওভারস্পিডিং। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় দূর্ঘটনার ৫৮ ভাগই হয়ে থাকে ওভারস্পিডিং এর কারনে। একজন রাইডারের অবশ্যই তার গতি সীমা সম্পর্কে জানতে হবে। অর্থাৎ কত স্পিড পর্যন্ত আপনি বাইকটিকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন সেটা জানা জরুরী।

প্রোপার ব্রেকিং টেকনিক ব্যবহার না করাঃ

আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাইকাররাই প্রোপার ব্রেকিং টেকনিক ব্যবহার করেন না। অনেকেই শুধুমাত্র ফ্রোন্ট ব্রেক অথবা রেয়ার ব্রেক প্রেস করে থাকেন। এজন্য এমারজেন্সি ব্রেকিংয়ের সময় বাইকের টায়ার স্কিডিং করে থাকে এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক মোটরসাইকেল এক্সপার্টরা বলেন, ব্রেকিংয়ের সময় অবশ্যই সামনের এবং পেছনের ব্রেক একই সাথে প্রেস করতে হবে এবং এর রেশিও হচ্ছে ৮০/২০। অর্থাৎ সামনের ব্রেকে ৮০ এবং পেছনের ব্রেকে ২০। এছাড়া প্রোপার ব্রেকিংয়ের জন্য ইঞ্জিন ব্রেকে অভ্যস্থ হতে হবে। ইমারজেন্সি ব্রেকিংয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের দেশি-বাইকার ইউটিউব চ্যানেলে ‘কিভাবে ইমারজেন্সি ব্রেকিং করবেন’ ভিডিওটি দেখতে পারেন।

ক্লোজ ওভারটেকিং বা ভুল ওভারটেকিংঃ

হাইওয়ে রাইডের সময় বাইকারদের মাঝে ওভারটেকিংয়ের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় বাইকাররা তাড়াহুড়ো করে ওভারটেকিং করে থাকে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে ওভারটেকিংয়ের সময় একটু ভুল হলেই দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে এবং এই দূর্ঘটনায় মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। তাই তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে এবং বুঝেশুনে ওভারটেকিং করতে হবে।

সামনের যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রাখাঃ

হাইওয়ে কিংবা সিটিতে রাইডের সময় আমরা সামনের যানবাহন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি না। আপনি যখন রাইড করবেন তখন অবশ্যই সামনের যানবাহন থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা করেবেন যেন সামনের গাড়িটি হঠাত ব্রেক করলে আপনি নোটিশ করার সময় পান এবং ব্রেক করতে পারেন। এই বিষয়টি গ্রুপ রাইডের সময়ও মেনে চলা উচিৎ। যেহেতু গ্রুপ রাইডের সময় সবাই একই লাইনে বাইক চালাতে হয় তাই সামনের বাইক থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখুন এবং কিছুটা ডানে কিংবা বামে থেকে রাইড করুন।

লেন পরিবর্তনের সময় ইন্ডিকেটর ব্যবহার না করাঃ

সম্প্রতি দি বিজনেস টাইম পত্রিকা ঢাকার ভিতর ৪৫১ জন বাইকারের মধ্যে একটি জরিপ চালায় যেখানে তারা উল্লেখ করে একজন বাইকার প্রতি মিনিটে ২-৬ বার লেন পরিবর্তন করেন এবং যেটি মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার অন্যতম কারন। তবে বাইকারদের এই লেন পরিবর্তনের প্রবনতার জন্য ট্রাফিক অনেকাংশে দায়ী। প্রতিবার লেন পরিবর্তনের সময় আপনি যেদিকে যেতে চান সে পাশের ইন্ডিকেটর ব্যবহার করুন। এছাড়া প্রতি মিনিটে ৬-৮ বার লুকিং গ্লাস ফলো করা উচিৎ।

বাইকে ত্রুটি থাকাঃ

অনেকেই বাইকের ত্রুটি থাকার পরেও রাইড করেন। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা হয়ে থাকে শতকরা ২০ ভাগ। তাই বাইকে যদি কোন ত্রুটি থাকে যেমন ক্লাচপ্লেট, ইঞ্জিনের সমস্যা, সময়মত ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন না করা, কার্বুরেটর কিংবা ফুয়েল ইঞ্জেকটরে ময়লা থাকলে সেটি পরিস্কার করা উচিৎ।

থ্রি-হুইলারঃ

সাধারনত ৩ চাকার যান যেমন, অটো-রিক্সা, C N G , নসিমন ইত্যাদি থেকে সাবধান থাকা উচিৎ। তাই হাইওয়েতে রাইডের সময় রাস্তার দুই দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশেষকরে যে যায়গাগুলোতে মোড় থাকে সে যায়গায় অবশ্যই হর্ন ব্যবহার করতে হবে।

স্বল্প অভিজ্ঞতায় বাইক চালানঃ

অনেকেই সম্পূর্নভাবে বাইক চালান না শিখেই রাস্তায় বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় ঈদের সময় এবং এই সময় দূর্ঘটনার প্রবনতাও বেশি দেখা যায়। অনেকেই বড়ভাই, বাবা কিংবা রিলেটিভ কারও বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন এবং বেশিরভাগই হেলমেট ব্যবহার করেন না। তাই যদি কেউ সঠিকভাবে বাইক চালাতে না পারে তাহলে তার হাতে বাইক না দেয়াই উত্তম। এছাড়া রাস্তা কম করার জন্য অনেকেই উল্টো পথে বাইক চালান যেটি দূর্ঘটনার অন্যতম কারন।

রিসার্চ এবং বাইকিং কমিউনিটির অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা দূর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। এছাড়া রাইডিংয়ের সময় অবশ্যই সার্টিফাইড হেলমেট এবং লং রাইডের সময় সেফটি গিয়ার পরতে হবে। দূর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচতে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত গতিতে এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব না করে রাইড করুন। কেননা আপনি যত দামি রাইডিং গিয়ার পড়েন না কেন সেটি আপনার কোন কাজেই আসবে না।

লিভ ফ্রি, রাইড সেফ…।