মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রি এবং বাইকারদের যত সমস্যা!

বাইক এখন আর বিলাসিতা নয়। এটি এখন নিত্য প্রয়োজনীয় একটি যানবাহন। বাইক একদিকে যেমন বাঁচিয়ে দিচ্ছে সময় তেমনি অন্য দিকে কমিয়ে দিচ্ছে অন্যান্য যানবাহন গুলোর চাপ। কিন্তু বাইক চালক এবং এই ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ীদের হরহামেশাই পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়। মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রি ও বাইকাররা কি কি বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়, সে সব নিয়েই আলোচনা করবো।

১) জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিঃ বাইকের জ্বালানি অর্থাৎ পেট্রোল এবং অকটেনের বর্ধিত এবং বহির্বিশ্বের সাথে অসামঞ্জস্য মূল্য বর্তমানে মোটরসাইকেল চালকদের কাছে সব থেকে বড় সমস্যা। রিজার্ভ সংকট এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে, ২০২২ সালের ৫ই আগস্ট হঠাৎ করেই বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় পঞ্চাশ পার্সেন্ট বৃদ্ধি করা হয়। সেই সময়, ডিজেলের দাম ৮০ টাকা থেকে ৪২.৫% বৃদ্ধি করে ১১৪ টাকা করা হয়, পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ৫১.১৬% বৃদ্ধি করে ১৩০ টাকা করা হয় এবং অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে ৫১.৬৯% বৃদ্ধি করে ১৩৫ টাকা করা হয়। যার ফলে বেড়ে যায় ভাড়ায় চালিত যানবাহন গুলোর ভাড়া ও টিকিটের দাম। ভাড়ায় চালিত যানবাহন গুলোর টিকিটের মূল্য বা ভাড়া বাড়লেও বিড়ম্বনায় পড়ে পার্সোনাল যানবাহন ব্যবহারকারীরা। বিশেষ করে এই বর্ধিত মূল্যের কারণে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাইক চালকেরা। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় বহির্বিশ্বের সাথে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো এবং বাড়ানো হয়েছে তবে এখন পর্যন্ত আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি আমরা। ফলে বাইকের চাকা সচল রাখতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করছি।

২) প্রতিকূল আমদানি শুল্ক ও উৎপাদন নীতিমালাঃ বাংলাদেশের মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলো CBU ও CKD আকারে আমদানি করে থাকে। CBU (complete build unit) আকারে একটি বাইক বাংলাদেশে আমদানি করতে গেলে কোম্পানিকে প্রায় ১৫১% ট্যাক্স ও ১% রেফারেন্স ভ্যালু ট্যাক্স দিতে হয়। আর CKD (complete Knock Down) ইউনিট আমদানি করতে গেলে প্রায় ১৩১% ট্যাক্স দিতে হয় কোম্পানিকে। একটি বাইক আমাদের হাতে আসার আগে বেসিক মূল্যের সাথে এই ১৫২% অথবা ১৩১% ট্যাক্স যোগ হয়, এরপর আরও যোগ হয় পরিবহণ খরচ ও অন্যান্য। যার ফলে যে বাইকটা পার্শ্ববর্তী দেশে মূল্য এক লক্ষ টাকা, সে বাইকটা আমরা হাতে পাই প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকায়। বাইকের এই অতিরিক্ত মূল্যের কারণে বাইকের বিক্রয় বিগত অর্থবছরের থেকে এই অর্থবছরে হ্রাস পেয়েছে। শুধু তাই নয় বড় বড় বাইক মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের মেনুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কঠোর নীতিমালার প্রণয়ন ও নীতিমালার পরিবর্তনের কারণে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। এতে ২৫০ সিসির ঊর্ধ্বসীমা ইঞ্জিন ক্ষমতা সম্পন্ন মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশগুলো আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ ধার্য করার সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী বলেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশ কাস্টমস ট্যারিফে সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিপরীতে বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ ধার্য করার সুপারিশ করেছেন তিনি। ফলে মোটরসাইকেলে দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

৩) সিসি লিমিটেশনঃ ২০০১ সালের আগে বাংলাদেশ বাইকের কোন সিসি লিমিট ছিল না। এরপর বাইকের উপরে লিমিটেশন দেয়া হয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৫০ সিসির উপরে বাইক আমদানি করা এবং ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। ২০১৭ তে এটাকে ১৬৫ সিসি পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। ২০২৩ সালে সরকার ১৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫ করে। কিন্তু বাইকের এই সিসির লিমিটেশন পৃথবীর আর কোনো দেশেই নেই। এই সিসির লিমিটেশন এর কারণে বাইকের বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছে না। শুধু তাই নয় লিমিটেশনের কারণে সাধারণ বাইকাররাও বঞ্চিত হচ্ছে আধুনিক টেকনোলজি ও তাদের চাওয়া পাওয়া থেকে। সিসি লিমিট বর্ধিত করার পরেও ম্যানুফ্যাকচারিং নীতিমালা এবং আমদানী শুল্ক বেশি হওয়ায় জায়ান্ট কোম্পানিগুলো হায়ার সিসি বাইক লঞ্চ করাতে হিমসিম খাচ্ছে।

৪) প্রতিকূল ট্রাফিক রুল ও বাইকার বান্ধব আইনের অভাবঃ অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ট্রাফিক রুলস বাইকার বান্ধব নয়। বর্তমানে যে ট্রাফিক রুলস গুলো রয়েছে এবং সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে যে জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য অতিরিক্ত বলে মনে করেন অনেকেই। রাস্তার কোন একটি সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকলে বোঝা যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরা বাইকারদের উপরে যতটা নজর দেন অন্যান্য যানবাহনের উপরে ঠিক ততটা নজর দেন না। বাইকাররা তাদের প্রয়োজনে দুটো ফগ লাইট ব্যবহার করতে পারেনা অথচ বড় বড় গাড়িগুলোতে প্রায় আট- দশটা লাইট ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয় বাংলাদেশে সরকারিভাবে সড়ক ও পরিবহন আইন শিখানো বা বুঝানোর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি কখনো।

৫) বিআরটিএ বিড়ম্বনাঃ সাধারণ বাইক চালকদের জন্য একদিকে যেমন ট্রাফিক রুলস এবং জরিমানা আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে বিআরটিএ বিড়ম্বনা বেড়েই চলেছে। সঠিক সময়ে প্রসেসিং না হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিটি বিআরটিএতে জমে রয়েছে অসংখ্য ফাইল। শুধু তাই নয় বাইকের নাম্বার প্লেট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স করতেও অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয় বাইক চালকদের। আবার অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য চালক ও ফিটনেস বিহীন গাড়িকেও পারমিশন দেয়া হয় বিআরটিএ থেকে। বিভিন্ন সময় এই দুর্নীতির কথা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে পড়লেও বিআরটিএকে দুর্নীতিমুক্ত করা এখনো সম্ভব হয়নি। ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও স্মার্ট কার্ড আসতে এখন প্রায় সময় লাগছে তিন মাস বা তারও অধিক। অন্যদিকে বাইক রেজিস্ট্রেশনের প্রসেস সম্পন্ন হওয়ার পরেও নাম্বার প্লেট এবং স্মার্ট কার্ড আসতে সময় লাগছে প্রায় ছয় মাস এবং তারও অধিক। অথচ বাইকের প্রয়োজনীয় পেপার্স কিংবা ডকুমেন্ট সাথে না থাকলে আইন অনুযায়ী মামলা অনিবার্য।

৬) বাইকার বান্ধব রাস্তার অভাব ও বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞাঃ বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের বেশ উন্নতি সাধন হলেও এই রাস্তাগুলো বাইকার বান্ধব নয়। সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে বাইক চলাচলের জন্য কোন আলাদা লেন নেই। সড়ক ও মহাসড়ক গুলোর জন্য নির্দিষ্ট গতিসীমা থাকলেও তা মানে না বড় গাড়িগুলো। তার উপর আবার গত কিছুদিন আগে ঢাকা সিটিতে বাইকের গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় ৩০-৪০ প্রতি ঘন্টা। বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং মহাসড়ক যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদিতে বাইক চলাচল এখনো বন্ধ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মতন গুরুত্বপূর্ণ একটি সেতুতে বাইক চলাচল বন্ধ ছিল। যেখানে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সকল ট্যাক্স ভ্যাট এবং নিয়মকানুন মেনে একটি বাইক রাস্তায় চলাচল করে সেখানে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে কেন বাইক চলাচল করতে পারবে না তা অনেকেরই বোধগম্য নয়।

৭) দেশীয় মোটর সাইকেল ব্র্যান্ডের প্রতি উদাসীনতাঃ বাংলাদেশের দেশীয় মোটরসাইকেল ব্র্যন্ডগুলো দিনদিন মার্কেট থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। রানারের মত ব্র্যান্ড টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন ভারত, তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডগুলো ভালোভাবে এস্ট্যাবলিশ করছে, তাদের নীতিমালা অনুযায়ী বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোকে যৌথ উদ্দ্যোগে কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর সাথে। এতে করে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো নতুন করে একটি জায়গা তৈরি করে নিতে পারছে মার্কেটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইন্ডিয়াতে বর্তমানে টিভিএস এবং বিএমডাব্লিউ এখন একসাথে কাজ, বাজাজের সাথে কাজ করতো কাওয়াসাকি এবং এখন কেটিএম। আমাদের দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি সরকারের আরো দৃষ্টিপাত করা উচিত।

৮) মোটর স্পোর্টসের অভাবঃ বিশ্বব্যাপী মোটরস্পোর্টস অনেক জনপ্রিয়। মটোজিপি, ডাকার র‍্যালি, সেন্ট ম্যানিয়া বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় মটর স্পোর্টস। এই স্পোর্টসগুলোর মাধ্যমে একই সাথে বাংলাদেশকে যেমন রিপ্রেজেন্ট করা যেত ঠিক একইভাবে আয় করা যেত বৈদেশিক মুদ্রা। মটর স্পোর্টসকে বিকশিত করার জন্য হলেও ছোট আকারে হলো বাংলাদেশের একটি রেস ট্র্যাক অত্যন্ত জরুরী।

 

১০) মোডিফিকেশন নিষেধাজ্ঞাঃপুরো বিশ্বজুড়ে কাস্টম মেইড মোটরসাইকেলগুলো অনেক জনপ্রিয়। অথচ বাংলাদেশের সড়ক ও পরিবহন আইন অনুযায়ী মোটরসাইকেলে কোনো রকম মোডিফিকেশন করা দন্ডনীয় অপরাধ। অথচ নিজের পছন্দের মোটরসাইকেলটির পারফরম্যান্স কে না একটু বৃদ্ধি করতে চায়।

পরিশেষে, বিশ্ব বাজারে সঙ্গে জ্বালানি তেলের নতুন সমন্বয় এবং বাইক চালকদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি আশা করছি।

অলি আহাদ খান

Related Posts

Add Comment

রিপ্লে দিন

error: Content is protected !!