ফুয়েল ইঞ্জেকশন ইঞ্জিনের উপকারিতা কি?

কার্বুরেটর অথবা ফুয়েল ইনজেকশন ইঞ্জিন, এদের মধ্যে কোনটি ভালো। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়সই বিতর্ক দেখা যায়। আমরা অনেকেই এই দুটির তফাৎ জানি না এবং জানি না যে কোন ইঞ্জিনটি আমাদের ভালো পার্ফরমেন্স দেয়। আজ আমরা দেশি বাইকার টিম এই দুই ইঞ্জিনের সবদিক তুলে ধরার চেষ্টা করব আপনাদের সামনে।

আমাদের প্রায় সব ইঞ্জিনের জন্য গ্যাসলিনের প্রয়োজন হয় কিন্তু আমরা কি এটা জানি যে শুধুমাত্র গ্যাসোলিন বা ফুয়েল দিয়ে একটি ইঞ্জিন চালনা করা সম্ভব না। শুনতে অবাক লাগলেও গ্যাসোলিনের সাথে বাতাস মিশ্রিত হয়ে ইঞ্জিনের অন্তর্দহন বা অভ্যন্তরীণ জ্বলনের সৃষ্টি হয় এবং ইহার সাথে তাপ যোগ হয়। অভ্যন্তরীণ দহন বা অন্তর্দহন তৈরিতে তিনটি জিনিস অবশ্যই প্রয়োজন। এর মধ্যে যদি একটি না থাকে তাহলে এদের মধ্যে রাসয়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হবে না এবং ইঞ্জিনের অন্তর্দহন সংঘটিত হবে না। তাই ইঞ্জিন সচল রাখতে শুধুমাত্র গ্যাসোলিন নয় গ্যাসোলিনের সাথে আমাদের প্রয়োজন বায়ু এবং তাপ।

কার্বুরেটর কি?

কার্বুরেটর হল একটা টানেল আকৃতির ডিভাইস যা সিলিন্ডারের ভিতরে ইঞ্জিনের অন্তর্দহনের জন্য বাতাস ও গ্যাসোলিনের সুষম মিশ্রণ তৈরী করে এবং অন্তর্দহনের সৃষ্টি করে। এটা অন্তর্দহনের জন্য সবসময় একটা অনুপাত মেনে চলে এবং ইঞ্জিনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সেই অনুপাতে অন্তর্দহন তৈরি করে। বিভিন্ন ধরনের কার্বুরেটর দেখা যায় কিন্তু বেশিরভাগ কার্বুরেটর একই রকম এবং এরা একই সিস্টেম মেনে চলে।

Carburetor

কার্বুরেটর ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করেঃ

কার্বুরেটর ইঞ্জিন ডাচ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বার্নোলি এর নীতিমালা মেনে চলে। তার মতে, যখন কোন সংকীর্ণ জায়গা দিয়ে তরল প্রবাহিত হয়, দ্রুত প্রবাহিত তরল ধীরে ধীরে প্রবাহিত তরলের চেয়ে কম চাপের তৈরি করে। আমরা এই সূত্র আমাদের চারপাশের অনেক কিছুতেই দেখতে পাই। মূলত কার্বুরেটর, ইঞ্জিনের তৈরি ভ্যাকুয়ামে বায়ু এবং গ্যাসোলিনের মিশ্রণ তৈরি করে । এখানে বাতাস ট্যাকনিক্যালি গ্যাস রূপে আসে এবং তরল পদার্থ হিসেবে প্রবাহিত হয়। কার্বুরেটরের মাধ্যমে বাতাস একটি ফিল্টারের প্রবেশ করে মাধ্যমে টিউবের উপরিভাগে প্রবাহিত হয়। কিছু কিছু কার্বুরেটরে টিউবের উপরিভাগে আবদ্ধ ভাল্ব দেখা যায় যা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত বাতাস ও ফুয়েল প্রবেশ করে। কার্বুরেটর চক সাধারণত দুই ধরনের হয় ম্যনুয়াল ও ইলেকট্রিক। ম্যানুয়াল কার্বুরেটর চকে বাতাসের প্রবাহের পরিমাণ ইচ্ছা মত বাড়ানো কমানো যায়। ইলেকট্রিক কার্বুরেটর চকে ব্যবস্থায় বাতাসের পরিমাণ নিজে থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এটি অটোমেটিক্যালি নিদৃষ্ট পরিমাণ বাতাস নিয়ে থাকে। ম্যনুয়াল কার্বুরেটর চকের অভ্যন্তরে লিভার থাকে যা দ্বারা বাতাস প্রবাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রন করা যায়, অন্যদিকে ইলেকট্রিক চকে কোন লিভার বা ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল করার মত কিছু থাকে না এবং এটি নিজে থেকে নিদৃষ্ট পরিমাণ বাতাস অভ্যন্তরে সঞ্চালন করে। কার্বুরেটরে টিউবের নিচের অংশকে ভেঞ্চুরি বলা হয় এবং বাতাস যখন ভেঞ্চুরি দ্বারা প্রবেশ করে তখন নিম্ন চাপের কারনে বাতাসের প্রবাহ দ্রুত গতির হয় । ভেঞ্চুরির মাঝখানে একটি ছোট রাস্তা থাকে যা জেট নামে পরিচিত। নিম্নচাপ ভেঞ্চুরি থেকে ভ্যাকুয়ামের তৈরি করে এবং জেট থেকে ফুয়েল এনে বাতাসের সাথে মিশ্রিত করে। ফুয়েল একটা এটাচ চেম্বার থেকে পরিমাণ মত নিঃসরিত হয় এবং বাতাসের সাথে মিশ্রিত হয় ।

আমরা জানি যে থ্রটল কার্বুরেটরের নিচে একটি বাটারফ্লাই ভাল্বের মধ্যে যুক্ত থাকে, এটি নিদৃষ্ট পরিমাণে ফুয়েল ও বায়ু, নিদৃষ্ট সময়ের মধ্যে মিশ্রিত করার জন্য সিলিন্ডারে পাঠিয়ে দেয় । তাই থ্রটলে জোরে চাপ দিলে বেশি পরিমাণে বায়ু ও ফুয়েল মিশ্রিত হয় এবং বেশি শক্তির সঞ্চার করে এবং ফলাফলে বাইকের গতি বেশি হয় । যখন থ্রটলের চাপ আমারা বন্ধ করে দেই তখন ফুয়েলের প্রবাহ থেমে যায় এবং আস্তে আস্তে ইঞ্জিনও থেমে যায়।

ফুয়েল ইঞ্জেকশন কি?

ইদানীং আমরা অনেক ইঞ্জিনেই ফুয়েল ইঞ্জেকশন দেখতে পাই, মূলত ইঞ্জিনকে বেশি শক্তিশালী করার জন্য ফুয়েল ইঞ্জেকশন ব্যবহৃত হয়। ইহা ইঞ্জিনে খুব দ্রুত কাজ করে এবং বাইকের ঠাণ্ডাজনিত কারণ থেকে বাইককে রক্ষা করে দ্রুত স্টার্ট করতে সাহায্য করে । ফুয়েল ইঞ্জেকশন একটু জটিল ভাবে কাজ করে । ফুয়েল ইঞ্জেকশনে অন্তর্দহনের জন্য একটি আলাদা কার্বুরেটর থাকে এবং ফুয়েল ইঞ্জেকশনের উচ্চচাপের প্রয়োজন হয় যা ফুয়েল পাম্প করে ইঞ্জেক্টরের নজেলের দিকে নিয়ে যায় এবং নজেল ফুয়েলকে অটোমাইজ করে। অটোমাইজ ফুয়েলকে বাস্পে রূপান্তরিত করে এবং বাতাসের সাথে মিশ্রিত করে তাপের মাধ্যমে অন্তর্দহনের তৈরি করে।

ফুয়েল ইঞ্জেকটর

ফুয়েল ইঞ্জেকশন কিভাবে কাজ করেঃ

ফুয়েল ইঞ্জেকশন সিস্টেমকে একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত প্রোগ্রাম দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফুয়েল ইঞ্জেকশন ইঞ্জিনে ফুয়েল পাম্প করে ট্যাঙ্কের ভিতর থেকে প্রবাহিত করা হয় । এই ফুয়েল, ফুয়েল লাইন দিয়ে প্রবাহিত হয়, প্রবাহিত হওয়ার আগে সম্পুর্নরুপে ফিল্টার হয়ে আসে। একটি ফুয়েল রেগুলেটরের মাধ্যমে চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং পরিমাণ নির্ধারন করা হয় । ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিট বা ইসিউ দ্বারা নির্দেশ করা হয় যে কি পরিমাণ ফুয়েল সিলিন্ডারে প্রবেশ করবে এবং কত সময় ধরে ইঞ্জেকটরের মুখ খোলা থাকবে । সাধারণভাবে বলতে গেলে ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিট বা ইসিউ নির্ধারন করে কখন ফুয়েল প্রবাহ বন্ধ হবে এবং এটি তার নির্দেশ ভাল্বে প্রেরণ করে । সলিনয়েড ভাল্বের দ্বারা একটি চৌম্বকীয় অবস্থার তৈরি হয় এবং একটি তড়িৎ চৌম্বক প্লাগের সাথে লাগানো থাকে এবং ইহা ফুয়েলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে । ইসিউ কে, ভোল্টেজ সেন্সর, ম্যাস এয়ারফ্লো সেন্সর, অক্সিজেন সেন্সর, এবং প্রেশার সেন্সর তথ্য দেয় যে কি পরিমাণ ফুয়েল প্রবাহিত করতে হবে । ইসিউ বাইকের স্পীড নিয়িন্ত্রন করে এবং করে বাইক থেমে থাকা অবস্থায় এটি স্পীডের সিগন্যাল থ্রটলে প্রেরণ করে।

কার্বুরেটর বনাম ফুয়েল ইঞ্জেকশনঃ

কার্বুরেটর ও ফুয়েল ইঞ্জেকশন দুটোর বেসিক কাজ একই । এই দুটোই ট্যাঙ্ক থেকে ফুয়েল নিয়ে প্রকৃতি থেকে বাতাস সরবরাহ করে ইঞ্জিনের ভেতরে অন্তর্দহনের সৃষ্টি করে এবং বাইকে চালনার শক্তি সঞ্চার করে। কার্বুরেটর একটি পুরাতন প্রযুক্তি এবং ফুয়েল ইঞ্জেকশন একটি সম্পূর্ন নতুন প্রযুক্তি। কার্বুরেটর ফুয়েল ইনজেকশনের চেয়ে ধীরে কাজ করে। বিশেষ করে যারা পাহাড়ে বাইক চালনা করেন তাদের জন্য কার্বুরেটর ইঞ্জিন একটু সমস্যা তৈরি করে, কারণ পাহাড়ে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম। ফুয়েল ইঞ্জেকশন, কার্বুরেটরের চেয়ে একটু জটিল প্রক্রিয়া এবং আমাদের দেশে অনেক নতুন, তাই অনেক মেকানিক এর ইঞ্জিনের সাথে পরিচিত নয়। অপরদিকে কার্বুরেটর পুরাতন প্রযুক্তি হওয়ায় আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেকানিক এর সাথে আগে থেকেই পরিচিত। তাই কার্বুরেটর ইঞ্জিনের বাইক আপনি যে কোন জায়গা থেকে ঠিক করে নিতে পারবেন যা ফুয়েল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। যদিও বর্তমানে বাইক গুলোতে ফুয়েল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর কারণ হল ফুয়েল ইঞ্জেকশন ইঞ্জিন অনেক জ্বালানি সাশ্রয়ী, জ্বালানির অপচয় করে না এবং এটি অনেক ঠাণ্ডাতেও ইঞ্জিন চালু করতে পারদর্শী ।