[পর্ব ২] ২২০০ কিঃমিঃ বাইক ভ্রমণের গল্প (রংপুর-রাঙ্গামাটি-সাজেক-কক্সবাজার-রংপুর)

ঘুম ভাঙলো সকাল ৮টায়। রাঙ্গামাটিতে দেখার মত আরো বেশ কিছু জায়গা আছে ঠিকই কিন্তু আমাদের হাতে সময় মাত্র ৭ দিন। পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে সৌন্দর্য্যের অপার লীলাভূমি আর আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমাদের দেশে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবনের মত পাহাড়ি জনপদ রয়েছে। কিন্তু এই সৌন্দর্য্য দেখে শেষ করতে হাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই আমাদের টার্গেট সব জেলাগুলোতে যাওয়া এবং নামকরা জায়গাগুলো অন্ততঃ ঘুরে দেখা। বিগত কয়েক বছরে সাজেক হয়ে উঠেছে দর্শনার্থীদের প্রাণকেন্দ্র। এই ট্যুরে সাজেক কোন ভাবেই মিস করা ঠিক হবে না।

সবাইকে বললাম তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিতে কারণ আমরা এখনই রাঙ্গামাটি ছাড়ব খাগড়াছড়ির উদ্দ্যেশে। রেডী হয়ে সবাই নাস্তা করে নিলাম। হোটেল ছাড়লাম আর বিদায় নিলাম রাঙ্গামাটির বাইকারদের কাছ থেকে। ওরা আমাদের খাগড়াছড়ি যাওয়ার রাস্তা বলে দিলেন আর আমি মিলিয়ে নিলাম গুগল ম্যাপের সাথে। রাঙ্গামাটি ছাড়তে ছাড়তে প্রায় সাড়ে ১০টা বেজে গেল। আমাদের এই ট্যুর পুরোটাই ছিল পরিকল্পনা বিহীন। “যেখানে রাত, সেখানেই কাত” –অনেকটা তেমনই। কিন্তু একটা বিষয় সবসময় মাথায় ছিল যে, টাইম মেইনটেইন না করলে গন্তব্যে পৌছানো যাবে না।

Manikchari to Mohalchari Road

মানিকছড়ি, মহালছড়ি হয়ে আমরা খাগড়াছড়ি শহরের দিকে চলতে থাকলাম। আমাদের টার্গেট ২টার মধ্যে অন্ততঃ খাগড়াছড়ি শহরে পৌছানো আর ৩টার মধ্যে দীঘিনালা ক্রস করা। আগের পর্বে বলেছিলাম যে, সকাল ১০টা এবং বিকেল ৩টায় আর্মিদের স্কোয়াড পর্যটকদের সাজেক পর্যন্ত যেতে গাইড করে। সাধারনত আর্মিদের স্কোয়াড ছাড়া কাউকে এই পথে আর্মিরা সাজেক যেতে দেয় না।

রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ির এই রাস্তা পাহাড়ের গা ঘেষে হলেও প্রায় পুরো পথটি সমতল। রাস্তা বেশ ভাল, কিছুটা সরু এবং কিছু দূর পর পর স্পীড ব্রেকার রয়েছে। পথে ২ বার আর্মি ক্যাম্পে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব প্রায় ৭০ কিঃমিঃ আর আমরা এতক্ষণে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পথ চলে এসেছি। শুরু হল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি তবে ভিজে যাবার মত নয়। দুই চাকায় ভর করে আপন মনে চলতে থাকলাম এই খানিকটা উচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তায়। আমরা তখন খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র ২ কিঃমিঃ দূরে আর তখন ঘড়িতে প্রায় বেলা ১টা ৩০ মিনিট। হটাৎ শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি করে একটা চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলাম। হালকা বৃষ্টিতে ভেজার পর চায়ের কাপে চুমুক দিলে মন্দ হয় না। সাথে পেয়ে গেলাম গরম সিঙ্গারা। কিন্তু একটু হতাশা কাজ করছিল, আজ হয়তো আর সাজেক যাওয়া হবে না। একে বৃষ্টি কখন থামে আর আর্মিদের স্কোয়াড মিস করলে আবার ব্যাক করে আজ রাতটা খাগড়াছড়ি শহরেই থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে থেকে বৃষ্টি থেকে গেল। এখানেই প্রায় বেলা ২টা বেজে গেছে। চেষ্টা ছাড়া যাবে না তাই আমরা সময় নষ্ট না করে আবার রওনা করলাম। খাগড়াছড়ি শহরে এসে ২-১ জন চান্দের গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে নিলাম যে, এখন রওনা করলে আমরা আর্মিদের স্কোয়াড ধরতে পারব কিনা আর কোন পথ ধরে সাজেকের দিকে যেতে হবে ? ওরা আমাদের পথ দেখিয়ে দিলেন আর বললেন “আমরাও যাচ্ছি তো সাজেক। এখনি রওনা দিলে চলে যেতে পারবেন”। খাগড়াছড়ি শহর পাড় হয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে এগুতে লাগলাম। সাজেক পৌঁছাতে এখনও প্রায় ৭০-৮০ কিঃমিঃ পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।

প্রায় ৪০ কিঃমিঃ আসার পরে একটি আর্মি ক্যাম্পে দাড়াতে হল। গ্রুপ থেকে ১জনকে গিয়ে নাম এনট্রি করতে হয়। কবে ব্যাক করবেন? সাজেকে কোন রিসোর্ট বুকিং আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় নোট করে ওনারা নাম্বারসহ একটি টোকেন দেন এবং বলেন যে, কিছু দূর পথ গিয়ে একটা পুলিশের ক্যাম্প পাবেন, সেখানে এই টোকেনটি দেখতে হবে এবং যখন যেতে বলবে তখনই যাবেন। ২ – ১ কিঃমিঃ যাওয়ার পর আমরা একটি পুলিশ ক্যাম্প পাই। বুঝতে পারলাম এখান থেকেই প্রতিদিন আর্মিদের স্কোয়াড দর্শনার্থীদের সাজেক যেতে গাইড করে। ২০-২৫টি চান্দের গাড়ি লাইন হয়ে আছে পুলিশের নির্দেশের অপেক্ষায়। ভালই হল, আমাদের একটা শর্ট ব্রেকের প্রয়োজন ছিল। একজন বিজিবি’র সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, আজ আর্মিদের কোন স্কোয়াড যাচ্ছে না। সারাদিন যে কোন সময় দর্শনার্থীরা সাজেক যেতে পারছেন কারণ পূজার ছুটিতে প্রচুর পর্যটক সাজেক যাচ্ছেন। আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল, নয়তো এত বেলা করে এখানে আসলে আমাদের সাজেক যেতে দিত না।

On the way to Sajek

হটাৎ শুরু হল মুষূলধারে বৃষ্টি। বাইকের পিছনে ব্যাগ যেভাবে টাইট করে বাধা সেটা খুলতে খুলতে বৃষ্টিতে ভিজে যেতে হবে। আগের পর্বেই বলেছি যে, বলা স্বত্তেও আমাদের ৫ জনের মধ্যে ৩ জনই রেইনকোর্ট সাথে নেয়নি। বৃষ্টি থামার কোন উপক্রম দেখি না, চান্দের গাড়িগুলো এক এক করে সব চলে যাচ্ছে আর সন্ধ্যার বেশ আগেই আমাদের সাজেক পৌছাতে হবে। শুরু হল ঝুম বৃষ্টিতে পাহাড়ী উঁচু-নিচু রাস্তায় চলতে থাকা। পিলিওন নিয়ে বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় বাইক রাইড করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং যদি রাস্তা পিচ্ছিল হয়। তবে সাজেকে যাওয়া আসার রাস্তার মান বেশ ভাল হওয়ায় আমরা বৃষ্টিতে বাইক রাইডিং বেশ উপভোগ করতে থাকি। রাস্তা থেকে বেশ কিছু জায়গায় পাহাড়ের ভিউ দেখে মনে হচ্ছিল, এখানেই আজীবন থেকে যাই।

Way to Sajek Valley

একে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গেছে, ঠান্ডা আবহাওয়া সব মিলিয়ে শরীরে যেন কাপুনী ধরার উপক্রম। আমার বাইকের পিলিওন ছিল শুভ। বললাম, দাদা গাণ ধর। দুই জন মিলে বেসুর গলায় গাইতে থাকলাম “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে। আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে। তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে।” বেশ কাজে লেগেছিল মনে হয় এই বেসুর গলার গান। সাজেক যাওয়ার ৩ কিঃমিঃ আগে উপজাতিদের একটা চায়ের দোকানে ব্রেক নিলাম, তখনও ঝুম বৃষ্টি।

Khagrachari to Sajek

আমরা সাজেকে পৌছালাম ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার কয়েক মিনিট আগে। আমরা এমন একটা সময় সাজেক এসেছি যে সময় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়, আর আমরা কোন রিসোর্ট কিংবা কটেজ বুক না করে চলে এসেছি। সকালের নাস্তার পর তেমন কিছুই পেটে পড়েনি। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় এক একজনের অবস্থা বেহাল। কোন কটেজ/রিসোর্ট ফাকা নেই, এমনকি কটেজের বাড়ান্দাগুলো ভাড়া নিচ্ছে একরাত ৩০০০-৪০০০ টাকায়। পকেটে টাকা থাকলেই যে সব সময় কাজে আসে না সেটা ওই দিন আরো হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও রুম পেলাম না। এতো সত্যি সত্যিই বিপদে পড়ার উপক্রম।

কিন্তু আল্লাহর রহমতে, যেখানেই বিপদ, সেখানেই আমাদের দেশি-বাইকারের ভাইদের সহযোগিতা আমরা পাই। রাঙ্গামাটি থেকে ফেরার আগে মনিরুল বাশার ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল, উনি খাগড়াছড়ির স্থানীয়। কথা ছিল খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছে দেখা করব কিন্তু সময়ের অভাবে দেখা করতে পারিনি। বাশার ভাইয়ের সাথে দেখা করে কটেজ বুকিং করে সাজেকে আসলে হয়তো এই পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না সাজেকে, অন্য সিমগুলোতে ব্যলেন্স নেই, সব দিকেই যেন বিপদ। অপিরিচিত একজনের ফোন থেকে ওই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি। উনি সাধ্যমত পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে কিন্তু আমরাও বুঝতে পারলাম যে, এখানে আসলেই কোন রুম ফাকা নেই, আমাদের দিবে কোথা থেকে। অবশেষে বাশার ভাইয়ের প্রচেষ্টায় পরিচিত একজনের মাধ্যমে আমরা একটা উপজাতিদের কটেজ পেয়ে যাই। আহ… এবারের মত বাঁচা গেল।

বৃষ্টিতে ব্যাগের প্রায় সব কাপড় ভিজে গেছে, এখন উপায়? ২ – ১টা মোটামুটি পড়ার উপযোগী প্যান্ট, শার্ট পেলাম। “ক্ষুধার রাজ্যে প্রথিবী গদ্যময়” আমরা সবাই মিলে বের হলাম রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে। আমাদের কটেজের পাশেই ৪জন উপজাতি পুরুষ, মহিলা মনের আনন্দে তাশ খেলছেন আর তাদের নিজস্ব ভাষায় ভাবের আদান প্রদান করছেন। অনেক পর্যটক থাকায় সাজেকের রুইলুই পাড়ায় বেশ ভীড় যদিও রাতে দেখার মত কোন কিছুই নেই পাহাড়ে। খাবারের জন্য একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। খাবারের দাম একটু বেশি, মান মোটামুটি বলা যেতে পারে। খাওয়া শেষ করে খানিকটা হাটাহাটি করে শুয়ে পড়লাম। এখন মাত্র বর্ষার শেষের দিক, উত্তরবঙ্গেও শীত পড়তে এখনও মাসখানেক বাকি কিন্তু রাতে এখানে প্রচুর ঠান্ডা। কম্বল মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষন ফোন চাপাচাপি করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

Sajek Valley, Rangamati

ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে ৬ টায়। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম সাজেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখতে। চারদিকের পুরো পাহাড় মেঘে আচ্ছন্ন। সময় যত যাচ্ছে মেঘের পরিমাণ তত কমছে আর সুউচ্চ পাহাড়গুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য্য দেখার জন্য সাজেক ভ্যালী আসলেই বাংলাদেশের অন্যতম একটি আকর্শনীয় জায়গা। শুধু সাজেক নয় বরং এমন পাহাড়ের রুপ দেখতে পাবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায়। সত্যি বলতে কি, যদি বাংলাদেশকে দেখতে চান, তবে পাহাড়ে চলে যান।

সকলেই যে যার মত ছবি তোলায় ব্যস্ত। সাজেকের আশে-পাশে ঘোরার মত তেমন কিছু নেই, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আজই সাজেক ছাড়ব। বান্দরবন আর কক্সবাজার ঘুরলেই আমাদের এই ট্যুর সার্থক। কিন্তু পিলিওনসহ ওলির পালসার ডিটিএসআই পাহাড়ি রাস্তায় কিছুটা ঝামেলা করছিল। পিলিওন, বৃষ্টি আর পালসার ইস্যু সব মিলিয়ে বান্দরবনের থানচি-আলিকদম রাস্তা আমাদের জন্য অনুপযোগী বলে মনে হল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা সরাসরি কক্সবাজারে চলে যাব আজই। ওলির সাথে যে পিলিওন ছিল তাকে খাগড়াছড়ির পর্যন্ত চান্দের গাড়িতে দিব বলে মনস্থির করলাম। কিন্তু ১ জনের জন্য পুরো চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নেয়া কিছুটা ব্যয়বহুল হয়ে যায়। অনেকের সাথে ভাড়া শেয়ার করার প্রস্তাব দিলাম কিন্তু কাজ হল না। এখন আর কিছু করার নেই, প্রায় সব চান্দের গাড়ি চলে যাচ্ছে। বেশি দেড়ী করলে আমরা রাতের মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছাতে পারব না।

একটা বিষয় বলে রাখি, উপজাতিরা খুব উদার মনের হয়। ওরা অথিতি পরায়ন আর কোন উপকারের বিনিময়ে টাকা চেয়ে বসেন না। আমাদের যিনি উপজাতিদের কটেজ ঠিক করে দিয়েছিলেন উনি বলেছিলেন যে, আপনারা খুশি হয়ে কটেজ ভাড়া হিসেবে যা দিবেন ওতেই ওনারা খুশি। কিন্তু আমাদের এই উপকারের যথার্থ প্রতিদান আমাদের দেয়া উচিত। বিদায় নেয়ার সময় একটা কটেজের ভাড়া সাধারনত যে পরিমাণ হয় সেটাই দিলাম।

Deshi Biker at Sajek Valley

৩ বাইকে ৫ জন সাজেক ছাড়লাম বেলা সাড়ে ১১টায়। রাতে যেমন ঠান্ডা, দিনে তেমন গরম আর প্রচন্ড রোদ যেটা পাহাড়ের আর একটি বৈচিত্র্য। ৫-৭ কিঃমিঃ আসার পরে ওলির ব্যক সিটের পিলিওনকে একটা চান্দের গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় মোটামুটি জ্যাম বেধে গেল। চান্দের গাড়ির বাকিদের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। ওনারা ১০-১২জন বন্ধু-বান্ধব মিলে ঢাকা থেকে সাজেক এসেছিলেন। বাইক ট্যুরের ব্যাপারে ওনাদের আগ্রহের কথাও বললেন। ওনাদের ২ – ১ জনের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে। মামুন আবদুল্লাহ ভাইয়ের সাথে মাঝে মাঝেই ফেসবুকে চ্যাটিং হয়। পাহাড়ি রাস্তায় রাইডারের কনফিডেন্স আর বাইকের কন্ডিশন ভাল থাকা জরুরী। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় আমাদের মধ্যে একজনকে ভাইদের চান্দের গাড়িতে তুলে দিতে হয়েছে। আর ওই সময় চান্দের গাড়িও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই মামুন ভাইদের এই উপকারে আমরা বেশ উপক্রিত হয়েছিলাম। জ্যাম থেমে গেলে আমরা আবার বাইক নিয়ে চলতে শুরু করলাম। চান্দের গাড়িটি কিছুটা ধীর গতির ছিল তাই ৩০-৪০ কিঃমিঃ এসে আর্মিদের ক্যাম্পের কাছে আমরা একটা ব্রেক নিলাম। খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর ২টা বেজে গেল।

Road to Sajek

শহরে একটা টি-স্টলে মামুন ভাইদের সাথে আড্ডা চলল ঘন্টা খানেক। আমাদের প্ল্যান ছিল বাশার ভাইয়ের সাথে দেখা করেই আমরা খাগড়াছড়ি ত্যাগ করব। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা ফোন দিয়ে যোগাযোগ করার আগেই ভাই আমাদের চিনে ফেলেছেন কারণ ওই সময় উনি আমাদের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। যথা সময়ে ভাইদের সাথেও দেখা হয়ে গেল। বিস্তারিত কথা-বার্তা হল। ওটাই আমাদের বাশার ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন পূর্ব পরিচিত। আড্ডা দিতে দিতে কখন যে দুই-আড়াই ঘন্টা পেড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে, রাত ১২টার পর কক্সবাজারের রাস্তায় রাইড করা উচিত হবে না। বাশার ভাই, মামুন ভাইদের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা কক্সবাজারের উদ্দ্যেশে ছাড়লাম প্রায় বিকেল ৫টায়। অনেক দেড়ী করে ফেলেছি কিন্তু খাগড়াছড়ি শহরে থেকে গেলে আরও একটা দিন অতিরিক্ত লেগে যাবে।

মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, বিবিরহাট, হাটহাজারি, চট্টগ্রাম এই রুট ধরে চলতে থাকলাম। সন্ধ্যার আগেই আমরা পাহাড়ি রাস্তা পাড় করে এসেছি। চট্টগ্রাম শহরে পৌছানোর ১০-১৫ কিঃমিঃ আগে একটা ভাল হোটেল দেখে ব্রেক দিলাম তখন ঘড়িতে প্রায় আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। দুপুরের লাঞ্চ করলাম এই অবেলায়। প্রায় পৌনে ১ ঘন্টা ব্রেক দিয়ে আবার গন্তব্যের পথে ছুটতে থাকলাম। চিটাগাং শহর আমাদের কারোরই তেমন চেনা নেই, একমাত্র ভরসা গুগল ম্যাপ। গুগল ম্যাপ আমাদের সঠিক পথেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়েতে উঠিয়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু জ্যাম, ধূলাবালি, ভাঙ্গা রাস্তা সব মিলিয়ে এক একজনের বেহাল দশা বানিয়ে ছেড়েছে। প্রায় পৌনে ১০টা বেজে গেছে চট্টগ্রাম শহর পাড় হতে। এবার একটু হাফ ছেড়ে বাঁচা গেল। রাস্তা খুব একটা প্রশ্বস্ত না হলেও রাস্তার মান ভাল। একটা ব্রেক নিয়ে চা পান করে নিজেদের একটু চাঙ্গা করে নিলাম। রাত তখন বাজে ১০টা ১৫ মিনিট। আমাদের ৩টা বাইক সব সময় এক সাথে ছিল যেটা লং ট্যুর বিশেষ করে নাইট রাইডিংয়ের জন্য খুবই দরকার। আমরা মোটামুটি গতিতে আলো আধারের খেলায় চলতে থাকলাম কক্সবাজারের উদ্দ্যেশে। আমি বাকিদের বলে দিয়েছিলাম যেখান সেখানে না দাঁড়াতে। এভাবে চলতে চলতে প্রায় ১২টা বেজে গেল। এর আগে পর্যন্ত রাস্তায় বেশ বাস-ট্রাক চলাচল করছিল কিন্তু হটাৎ যেন সব থেমে গেল। সাধারনত নাইট কোচগুলো রাত ১০-১১টার মধ্যে ছেড়ে যায়, তাই কক্সবাজার থেকে ফেরা বাস-ট্রাকগুলো ইতোঃমধ্যে আমাদের পাস করে চলে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দ্যশে আসা বাস-ট্রাকগুলো আসতে এখনও অনেক দেড়ী। আমরা তখন কক্সবাজার থেকে প্রায় ৭০ কিঃমিঃ দূরে। যত দূর চোখ যায় কাউকে দেখা যায় না, রাস্তা পুরো শশান। শুনেছিলাম চকরিয়ার কাছাকাছি রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। আমরা ৩টা বাইকের ইন্ডিকেটর লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। আমার জানা মতে, আর কিছু দূর সামনে গেলে ২ দিকে বন, কোথাও লেখা হাতি চলাচলের পথ ! সাহস এবার যে একটু কমে গেল। কিন্তু আপততঃ সামনের দিকে চলা ছাড়া কোন উপায় দেখি না।

 

 

লেখকঃ দেওয়ান সোহান