নতুন বাইক কিনতে যাচ্ছেন তার আগে ছোট্ট একটা কাজ সেরে নিন, ভালো একটা হেলমেটের দোকানে যান, গিয়ে ভালো মানের একটা হেলমেট কিনে ফেলুন তারপর নিশ্চিন্তে বাইক কিনতে চলে যান। কারণ নতুন বাইকের যত্ন আপনি তখনি করতে সক্ষম যখন আপনি নিজের যত্ন করতে জানবেন।
এবার শুরু করা যাক, “নতুন বাইক কিনবো” বাক্যটার সাথে প্রতিটি বাইকার এর গভীর আবেগ আর এক অদ্ভূত অনুভূতি জড়িত থাকে। তাই প্রতিটি বাইকারই চান তার বাইকটা যেনো অন্য সবার চেয়ে ভালো দেখতে লাগে, আর সার্ভিসটাও যেনো দেয় অসাধারন। আপনার চাওয়াটা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন কিছু না, সামান্য কিছু যত্নই পারে আপনার চাহিদাটাকে বাস্তবায়ন করতে। চলুন এবার সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
নতুন বাইকের যত্ন ব্যাপারটাকে আমি দুই ভাগে ভাগ করে নিলাম,
১। বাহ্যিক যত্ন
২। অভ্যন্তরিন যত্ন অথবা ইঞ্জিনের যত্ন।
বাহ্যিক যত্নঃ
একটা প্রবাদ বাক্য দিয়ে লেখা টা শুরু করা যাক,
ছোট বেলা থেকেই আপনারা হয়তো একটা কথা শুনে আসছেন “আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী”
কথাটা দিয়ে বুঝানো হয়েছে যে কোন জিনিসের প্রথমে যে দিকটিতে সবার চোখ পরে সেটা হল সেটি দেখতে কেমন, তারপর আমরা সেটার গুনটা জানতে চায়।বাইকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতীক্রম ঘটে না। তাই বাইকের আউটলুক টা অনেক গুরুত্বপূর্ন।
কিভাবে বাইকের আউটলুক ঠিক রাখা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাকঃ
১। ভালো মানের কাভার ব্যবহার করা
ধুলাবালি বাইকের অন্যতম শত্রু।আমাদের সবার দৃষ্টিতে।রাস্তায় চলাচল করার সময় যে ধূলা লাগে তার থেকে বাইকে সেভ করা হয়তো সম্ভব না,কিন্তু কাভার ব্যবহার করার ফলে বাইককে বিভিন্ন প্রকার স্ক্রাচ অথবা দাগের হাত থেকে বাচানো সম্ভ। তাই নতুন বাইক কেনার সাথে সাথে আপনার বাইকের জন্য একটি ভালোমানের কাভার ও কিনে ফেলুন যেটি আপনার বাইকে রোদ,বৃষ্টি ধূলাবালির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষন।
২। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
দিন যাচ্ছে প্রযুক্তি আমাদের সামনে অনেক কিছুই নিয়ে আসছে।যার সঠিক ব্যবহারে আপনি আপনার বাইকটিকে রাখতে পারেন স্কাচ মুক্ত।
বর্তমান সময়ে বাজারে একধরনের পলি পেপার পাওয়া যায়।যা ব্যবহারের ফলে আপনার বাইকে কোন প্রকার স্কাচ পরবে না।
আমি প্রায় ২ বছর এই পেপার ব্যবহার করেছি এতে বাইকের রঙের কোন প্রকারের ক্ষতি হয় না,পেপারটি তুলে ফেললে আপনার বাইক হয়ে যায় একেবারে নতুনের মতন।
কোথা থেকে করাবেন এই পলি অথবা লেমেনেটিংঃ
যদি আপনি ঢাকায় বসবাস করেন তাহলে মিরপুর ১০ অথবা বংশালে চলে যেতে পারেন।
তাই নতুন বাইক কিনে সবার প্রথমে চলে যান এই জায়গাগুলোতে।
বর্তমান বাজারে আরেকটি জনপ্রিয় বাইক প্রোটেকশন সিস্টেমের নাম সিরামিক কোটিং। সিরামিক কোটিং ও আপনার বাইকে সকল প্রকারের স্কাচেচ হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।আমার দেখা অনেক বাইকার ভাইয়েরাই সিরামিক কোটিং করিয়েছেন তারা বেশ ভালো ফলাফল ও পাচ্ছেন।চাইলে আপনিও ট্রাই করে দেখতে পারেন।
৩। কড়া রৌদ্রের থেকে বাইকে দূরে রাখা
রাস্তায় চলার পথে বাইকে রোদ লাগবে এটা কমন একটা ব্যাপার। এতে বাইকের রঙের খুব একটা ক্ষতি হয় না।সমস্যার শুরু টা তখনি হয়, যখন কিনা আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা বাইকটি কাভার ছাড়া রৌদ্রের মধ্যে ফেলিয়ে রাখি।প্রাথমিক অবস্থায় এর ইফেক্টটা বুঝা যায় না, কিন্তু একটা সময় দেখতে পাবেন আপনার প্রিয় বাইকটি তার উজ্জ্বলতা হারিয়েছে।তাই এই কাজটি করা থেকে বিরত থাকুন।
৪। বাইক পরিস্কারের জন্য সঠিক কাপড় নির্বাচন করা
বাইকে দাগ পড়ার অন্যতম কারন হচ্ছে আমাদের নিজেদের গাফিলতি,আমরা অনেকেই হাতের কাছে যা পাই সেটা দিয়েই বাইক পরিস্কার করা শুরু করে দেয়।আপনি কি জানেন এটি আপনার বাইকের জন্য কত ক্ষতিকর।আপনি নিজের অজান্তেই নিজের বাইকের ট্যাংকিতে ছোট ছোট স্কাচ ফেলে দিচ্ছেন।তাই কাজটি করা থেকে বিরত থাকুন।চেস্টা করুন নরম সুতি কাপড় ব্যবহার করতে যাতে আপনার হাত দিয়েই আপনার বাইকে দাগ না পরে।
৫। তাড়াহুড়ো
যে কোন খারাপ জিনিসের জন্য দায়ী এই তাড়াহুড়ো ব্যাপারটি। বাইকের ক্ষেত্রেও ব্যতীক্রম ঘটে নি। সকালে অফিসে যাব অথবা ক্যাম্পাসে যাব এসে দেখলাম বাইকটি ধূলো দিয়ে মাখানো, তাড়াতাড়ি করে কাপড় একটা দিয়ে মেরে দিলাম ঘষা, ব্যাস করলেন তো ক্ষতি নিজের।
কেন ভাই নিজের ক্ষতি কিভাবে হল?
আপনি হয়তো বা জানেন না প্রতিটা রঙের উপরের আরেকটা আবরন থাকে যেটা আপনার বাইকের রংটাকে চকচকে দেখতে সহায়তা করে।আর ধূলা ওই আবরনের ক্ষতি করার জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে।
তাই বাইকের উপর ধূলো জমে থাকলে সরাসরি ঘষা দিবেন না,চেস্টা করুন কাপড় দিয়ে হাল্কাভাবে ওই ময়লাগুলো সরিয়ে নিতে তারপর নিজের ইচ্ছা মতন মুছে নিন।
৬। নিয়মিত বাইক ওয়াশ করানো
আমরা অনেকেই বাইক ওয়াশ করানোর ক্ষেত্রে একটু অলস। কিন্তু এটা আপনার বাইকের জন্য চরম ক্ষতিকর। এভাবেই একটা সময় বাইকের অনেক কিছু ক্ষতির মুখে পরতে পারে।তাই সব সময় চেস্টা করুন বাইকটি পরিস্কার রাখতে। গ্যারেজে যেতে মন না চাইলে নিজে পরিস্কার করুন।
তবে আমার মতে ওয়াস প্রোফেসনাল লোক দিয়ে করানো ভালো কারন আমাদের অধিকাংশ মানুষের কাছেই বাতাস দেয়ার যন্ত্রটি থাকে না, আর বাইক ওয়াসের পর বাইকের চাবি, সুইচ ও বিভিন্ন স্থান থেকে হাওয়ায় মাধ্যমে পানি বের ফেলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৭। স্টিকার এবং মডিফাই করতে গিয়ে কিছু ভূল পদক্ষেপ
আমি বাইকে স্টিকার মডিফাই করতে খুব পছন্দ করি, কিন্তু সব সময় বাইকের কথা মাথায় রেখে কাজটি আমি করি। আপনি যদি পুরা বাইকটি স্টিকার মডিফাই করাতে চান তাহলে আগে বাইকটি পলি করিয়ে নিন, তার উপর নিজের ইচ্ছা মতন স্টিকার ব্যবহার করুন, কিন্তু সরাসরি স্টিকার ব্যবহার করবেন না, এটি আপনার বাইকের রঙের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
৮। ভালো মানের স্প্রে পলিশ এবং স্ক্রাচ রিমুভার ব্যবহার করা
বাইক ওয়াশের পর একটি ভালোমানের স্প্রে পলিশ ব্যবহার করুন। এটি আপনার বাইকের চকচকে ভাব ধরে রাখতে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করে। আর ছোট খাটো স্ক্রাচ পরলে স্ক্রাচ রিমুভার ব্যবহার করে সাথে সাথে স্ক্রাচ তুলে ফেলুন।
৯। সচেতন থাকা
ঘর হোক আর বাহির এর চাইতে বড় যত্ন আর কিছুই হতে পারে না সেটা হল সচেতন থাকা।সব সময় সচেতন থাকুন দেখবেন আপনার বাইকটি আপনা আপনি ভালো থাকবে।
১০। ভালো মানের সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যবহার করা
বাইক কিনে সবার প্রথমে আপনার বাইকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, কারন বাইক চকচকা থাকলেই তো চলবে না আপনার কাছেও তো থাকতে হবে। যাই হোক বাজারে অনেক ভালোমানের লক পাওয়া যায় লকগুলি ব্যবহার করুন।
এছাড়াও অনেক ডিজিটাল সিকিউরিটি সিস্টেম আছে আপনি চাইলে ভালোভাবে খোজ নিয়ে এর মধ্যে যে কোন একটি আপনার বাইকে ব্যবহার করতে পারেন।
১১। অতিরিক্ত লাইটিং থেকে বিরত থাকুন
আমরা অনেকেই বাইক কিনে লাইটিং করে পুরা বাইক ভরে ফেলি। এটা না করায় উত্ত, হাল্কা লাইটিং করা ক্ষতির কিছু না, কিন্তু অতিরিক্ত লাইটিং আপনার ব্যাটারীর আয়ু খুব সহজেই কমিয়ে দেয়। তাই অতিরিক্ত লাইটিং পরিহার করুন।
১২। ব্যাটারীর যত্ন
যে কোন বাইকের ব্যাটারী বাইকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্। তাই শুরু থেকেই ব্যাটারীর যত্ন নিন।ব্যাটারীর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন।
মোটামুটিভাবে এই সব বাহ্যিক যত্ন নিলেই আপনার বাইকটি থাকবে সবার থেকে আলাদা, আর পুরনো হয়ে গেলেও সবার চোখ থাকবে আপনার বাইকের দিকে।
অভ্যন্তরীণ যত্ন অথবা ইঞ্জিনের যত্ন
১। ইঞ্জিনের যত্নের কথা আসতেই যে শব্দটি সবার প্রথমে আসে সেটা হচ্ছে, ব্রেক-ইন-পিরিয়ড।
ব্রেক-ইন-পিরিয়ড কি?
এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন এই লিংকেঃ
নিশ্চিয় জেনে গেছেন ব্রেক-ইন-পিরিযড কি?
এবার আমি বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচলা করি।
২। ভাল মানের ফুয়েল ব্যবহার করা
নতুন বাইক কেনার পর থেকেই চেস্টা করুন আপনার এলাকার সেরা ফুয়েলটি ব্যবহার করতে।কারন যে কোন বাইকের জন্যই ফুয়েল খুব গুরুত্বপূর্ন।আর ভালো মানের ফুয়েল ই দিবে আপনাকে অধিক মাইলেজ আর ইঞ্জিন ভালো থাকার নিশ্চয়তা।
আর হ্যা খোলা ফুয়েল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
৩। ইঞ্জিন অয়েলের দিকে লক্ষ্য রাখা
আমরা অনেকেই সামান্য কিছু টাকা সেভ করতে গিয়ে বাইকের আসক ক্ষতিটা করে ফেলি শুরুর দিকেই। কমদামি বাজে মানের ইঞ্জিন অয়েল আপনার বাইকের ইঞ্জিনের জন্য খুব ক্ষতিকর। তাই কাজটি করা থেকে বিরত থাকুন।শুরু থেকেই চেস্টা করুন আপনার বাইকের গ্রেড অনুযায়ী ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রেড চেঞ্জ করে ব্যবহারে ইঞ্জিনে তেমন কোন সমস্যা হয় না।আর এই পুরো ব্যাপারটি নিভর করে ইঞ্জিন অয়েলের উপর।
৪। ক্লাচ সঠিক পরিমানে রাখা
আমরা অনেকেই ক্লাচ খুব শক্ত রাখি আবার অনেকেই কিছুটা ঢিল করে রাখি, এটা করা থেকে রিরত থাকুন। কারন এই ব্যাপারটি ক্লাচ প্লেটের উপর ইফেক্ট ফেলে, ফলে আপনার নতুন বাইকের ক্লাচ প্লেট খুব সহজেই নস্ট হয়ে যেতে পারে। তখন কোম্পানিকে দোষ দিয়ে কি লাভ? তাই সচেতন থাকুন।
৫। চাকার প্রসার সঠিক রাখা
আমরা অনেকেই চাকার প্রসার কম রাখি, যাতে ঝাকুনি কম লাগে,কিন্তু এতে করে আপনার বাইকের ইঞ্জিনে একটা এক্সটা প্রেসার পরে। যা হতে পারে আপনার বাইকের ইঞ্জিনের ক্ষতির কারন। তাই সব সময় চাকার প্রেসার সঠিক রাখুন।
৬। অভিজ্ঞ লোক দিয়ে বাইকের ইঞ্জিনের কাজ করানো
প্রতিটি বাইকের প্রান হল তার ইঞ্জিন।তাই ইঞ্জিনের কাজ যেখান সেখান থেকে করাবেন না।যাকে দিয়ে কাজ করাবেন আগে সিউর হয়ে নিন সে অভিজ্ঞ কিনা।
৭। ইঞ্জিন হিট করে এমন মোডিফাই থেকে বিরত থাকা
এমন অনেক মোডিফাই আছে যা বাইকের ইঞ্জিনে ওভার হিট সৃষ্টি করে, এমন মোডিফাই করা থেকে বিরত থাকুন।
৮। এবার এমন একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করবো যে ভুল অধিকাংশ বাইকাররাই করে থাকে, নতুন বাইকে মাইলেজ খুব কম দেয়, অনেক বাইকেই।আর এই ব্যাপারটি হয়ে যায় অনেক বাইকারের চিন্তার কারন।বাইক নিয়ে চলে যায় সোজা এলাকার কোন ম্যাকানিকের দোকানে ভাই তেলের লাইনটা কমায় দেন।
৯। এয়ার ফিল্টার নিয়মিত পরিবর্তন করুন। মোটরবাইকের চেইনে গ্রিজ ব্যবহার করবেন না। গ্রেড অনুযায়ী চেইন অয়েল ব্যবহার করুন।
শুরু করে ফেলনেন নিজ হাতে নিজের প্রিয় বাইকের সর্বনাশের প্রথম পদক্ষেপ।এই কাজটি ভুলেও করবেন না। নতুন বাইক কিনে চালান ২০০০-২৫০০ কি.মি আগে ব্যবহার করুন তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
পরিশেষে কিছু কথা বলতে চাই, বাইকের পাশাপাশি নিজের যত্ন নিন সব সময় হেল্মেট ব্যবহার করুন, নিয়ন্ত্রিত গতিতে রাইড করুন।
লিখেছেনঃ আশিক মাহমুদ