একটি ১৮৫০+ কি:মি: বাইক ভ্রমণের গল্প [রংপুর-ঢাকা-সিলেট-রংপুর] – পার্ট ১

অফিস-কাজ-বাসা, এমন একঘেয়েমি জীবন থেকে বেঁচে থাকতে সুযোগ পেলেই যেদিকে খুশি বাইক নিয়ে ঘুরতে বের হই। এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে আমরা ২ – ৩জন মিলে পরিকল্পনা করি সিলেট ঘুরতে যাবো। আর কয়েকদিন ব্যাপী ট্যুরে, দল যত ভারী হবে, আনন্দও ততো বেশি। এটা ভেবে, পরিচিত বাইকারদের আমাদের সাথে যাওয়ার প্রস্তাব দেই।

আড়াই বছর হল ঢাকা ছেড়েছে, এখন রংপুরেই থাকি। এখানে ভ্রমণসঙ্গী খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। যাই হোক, এই সিদ্ধান্ত দাঁড়ালো যে, আমরা রংপুর থেকে ২ জন এবং ঢাকা থেকে ৫-৬ জন মিলে যাচ্ছি সিলেট. শেষ মুহূর্তে এসে জানতে পারলাম ঢাকা থেকে যারা আমাদের সাথে যাবেন বলেছিলেন, কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা আমাদের সাথে যেতে পারছেন না। তবে আমি আর আমার বন্ধু রুম্মান প্রথম থেকেই নিজেদের মাঝে কথা দিয়ে রেখেছিলাম যে, কেউ না গেলেও আমরা যাব।

২৯ এপ্রিল সকাল সাড়ে আট টায় রংপুর থেকে আমরা ২ বন্ধু মিলে যাত্রা শুরু করি। ইচ্ছে ছিল ফুড ভিলেজের আগে (প্রায় ১৪০কি:মি:) কোথাও ব্রেক দিব না, কিন্তু বগুড়া বাইপাস রোডে হাইওয়ে পুলিশের কাছে জেরা করতে খানিকটা সময় ব্যয় হয়ে গেল। যদিও তারা আমাদের সেফটির যথেষ্ট প্রশংসা করেন এবং আগ্রহ নিয়ে আমাদের ভ্রমণের পরিকল্পনা শুনেছেন. সকাল থেকে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি, ফুড ভিলেজ এসে আমরা মোটামুটি ক্ষুধার্থ। যদিও এটি প্রায় মধ্যাহ্নভোজনের সময় এবং ভাতের প্রতি মন একটু টানছিলো, তারপরও আমরা নাস্তা জাতীয় ভারী খাবার অর্ডার করলাম। আসলে লম্বা জার্নিতে ভাত পরিহার করাই ভালো, নয়তো চোখে ঘুম এসে যেতে পারে। ওই দিন সম্ভবত: আমরা নান রুটি, সবজি আর ফালুদা খেয়েছিলাম। বাইক চালাতে এতো সেফটি গার্ড দেখে অনেকেই একটু কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আসলে আমাদের উত্তরবঙ্গে এমনটা দৃশ্য কিছুটা কমই চোখে পরে। বিষয়টিতে আগে ইতস্তত লাগলেও, এখন বেশ মজাই পাই।

আমরা যদি আরো কিছুটা সকালে রওনা করতাম তাহলে ওই দিনই শ্রীমঙ্গল চলে যেতে পারতাম। এই ভ্রমণে আমাদের দিক নির্দেশনার জন্য আমরা সব সময় গুগল ম্যাপ ফলো করেছি। যদিও ২ – ১ বার বিপাকে পড়েছি, যেমন শর্ট-কার্ট রাস্তা খুঁজে গিয়ে কাঁচা, ভাঙা রাস্তা দিয়ে বাইক চালাতে হয়েছে। তারপরও শুধুমাত্র গুগল ম্যাপের কারণেই আমরা সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে আসতে পেরেছি কারো সহযোগিতা না ছাড়াই।

রংপুর থেকে যমুনা সেতু পার হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত আসা বেশ সাচ্ছন্দকর ছিল, কিন্তু ঢাকার আগের ৬০-৭০ কি:মি: রাস্তা রাইড করাটা ছিল বেশ অসহ্যকর। এমনিতেই এই রাস্তায় দূরপাল্লার যানবাহনের ভিড় খানিকটা বেশি, তার উপর রাস্তা ফোর লেন করার কাজ চলছে, তাই প্রচন্ড ধুলোবালি সহ্য করতে হয়েছে। শুধু ধুলোবালি নয়, ওই দিন রোদ আর গরমের তীব্রতাও ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তাই আর যাই হোক ২ – ৩ বার ব্রেক দিয়ে স্যালাইন পান করতে ভুলিনি। শরীর থেকে যেই পরিমান ঘাম বের হয়ে যাচ্ছিলো, তার ঘারতি পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। চারটার দিকে আমরা ঢাকা এসে পৌঁছোই. ঐ দিনটা ঢাকাতেই রেস্ট নিয়ে পরের দিন দুপুর আড়াইটার দিকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হই।

আমাদের ওই দিনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা থেকে সব থেকে কাছের দর্শনীয় স্থানে গিয়ে প্রথম রাতটি থাকা. যেহেতু সিলেট বিভাগের সব থেকে কাছের দর্শনীয় স্থান শ্রীমঙ্গল, তাই আমরা এটির উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় হাতে নিয়েই বের হই। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল-সিলেটের রাস্তা যথেষ্ট ভালো আর যানবহন অনেক কম, তাই এই রাস্তায় ড্রাইভ করাটা বেশ উপভোগ করি। যেহেতু আমাদের সাথে একটাই বাইক ছিল, তাই আমি, রুম্মান দুইজনই ভাগাভাগি করে চালাই। রাস্তা অনুযায়ী আমরা মোটামুটি বেশ গতিতেই বাইক চালিয়েছি, তবে কখনোই অন্য কোনো যানবহনের সাথে প্রতিযোগিতা করিনি। বরং আমরা সব সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই, নিজেদের মতো করে রাইড করেছি। আমি সবসময় রুম্মানকে বুঝিয়েছি যে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পরিহার করতে হবে। সব ঘুরে নিরাপদে ঘরে ফেরাটাই আমাদের উদ্দেশ্য, তাই আমরা তাড়াহুড়ো পরিহার করব। যদিও আসার দিন যমুনা ব্রিজের উপর এই ট্যুরের টপস্পিড ছিল ১২৬ কি:মি:/ঘন্টা, তবে যত পারা যায় বেশি স্পিড পরিহার করাটাই শ্রেয়।

এই ট্যুরে একদিনও আমাদের কোনো হোটেল কিংবা রিসোর্টে থাকতে হয়নি। রুম্মানের বোন-দুলাভাই শ্রীমঙ্গলেই থাকে আর আমাদেরকে তারা বেশ আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেন। ৩-৪ দিন ওখানে থেকে মনেই হয়নি যে আমি বাইরে কোথাও এসেছি। তাদের আপ্যায়ন এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণ আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে.

সিলেট বিভাগে দর্শনীয় জায়গার অভাব নেই. তবে একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব অনেক বেশি। যেমন ভাল একেকটি দর্শনীয় স্থান বাইকে ঘুরে আসতে আমাদের প্রতিদিন অন্তত: ২০০ – ২৫০ কি:মি: রান করতে হয়েছে. তাই কেউ যদি সিলেট বিভাগের সব নামকরা জায়গাগুলো ভ্রমণে আসতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই হাতে অন্তত: ৮-১০ দিন সময় নিয়ে আসা উচিত। সাথে বাইক থাকাতে আমরা মোটামুটি দ্রুত একটি স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার যেমন সুবিধা পেয়েছি, আবার বাইকের জন্যই কিছু স্পটে যেতে পারিনি।

সিলেট বিভাগের প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে জাফলং, তামাবিল, বিছানাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, মাধবকুন্ড, শ্রীমঙ্গল (চা বাগান, লাওয়াছরা বন, মাধবপুর লেক), লালাখাল, হামহাম জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর ইত্যাদি. আমরা এখানে সর্বোচ্চ ৩ – ৪ দিন সময় নিয়ে এসেছি, তাই সব থেকে নামকরা জায়গাগুলো দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম.

প্রথম দিন শ্রীমঙ্গল থেকে জাফলং-এর (দূরত্ব ১৩৩ কি:মি:) উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। যেহেতু ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠার অভ্যাস তাই আমাদের রওনা দিতে প্রায় ১১টা বেজে গেলো. আর সিদ্ধান্ত নিলাম আজ রাতটা সিলেট শহরে থেকে যাব. গুগল ম্যাপ ফলো করে আমরা খুব সহজেই জাফলং পৌঁছে যাই। শ্রীমঙ্গল থেকে সিলেটের রাস্তা যেমন প্রসস্ত, তেমন ফাঁকা তাই আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই সিলেটে পৌঁছে যাই। সিলেট সদর থেকে জাফলং-এর দূরত্ব ৫৭ কি:মি: যার প্রায় ৪০ কি:মি: রাস্তা বেশ ভালো। এরপর কোথাও ভালো, কোথাও খারাপ হতে হতে শেষের দিকের ৭-৮ কি:মি: রাস্তা বেশ খানিকটা খারাপ।

আমরা যত বর্ডারের দিকে এগুচ্ছিলাম, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কারণ দূর থেকে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি এবং মাঝে মাঝে কিছু ঝর্ণা দেখা যাচ্ছিলো। বেশ প্রশান্তি অনুভব হচ্ছিলো যে অতঃপর এত কি:মি: পাড়ি দিয়ে আমরা মনোমুগ্ধকর একটি জায়গায় পৌঁছাচ্ছি। তামাবিলের থেকে আমরা যেহেতু জাফলংয়ের নাম বেশি শুনেছি তাই আমরা জাফলংয়ের রাস্তা ধরেই আগালাম। এই রাস্তায় কাদা, ইট-পাথর ফেলা, মাঝে মাঝে খানিকটা উঁচু-নিচু। পাথর বোঝাই বড় বড় ট্রাক আর রাস্তার পাশে ছোট খাটো বেশ কিছু পাহাড়ি টিলা।

বুঝতে পারলাম যে, আমরা জাফলং স্পটের খুব কাছে। কিন্তু কোন রাস্তা ধরে গেলে স্পটে যেতে পারবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ২ – ১ জনকে জিজ্ঞেস করে আমরা ঠিক শেষ সীমান্তে পৌঁছে যাই, যেখানে সব পর্যটকরা ভিড় করে আছে। মোটরসাইকেল রাখার জন্য একটা গ্যারেজ পেলেও খুব একটা আস্থা পেলাম না, তাই বাইক নিয়েই চলে গেলাম। আমরা খুব হতাশ হই। যতদূর পর্যন্ত সমতল ভুমি সেটুকু বাংলাদেশের আর ঠিক যেখান থেকে পাহাড় শুরু হয়েছে সেখান থেকে ভারতের সীমান্ত শুরু। নিচ থেকে দাঁড়িয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের একাংশ দেখে খুব আফসোস হচ্ছিল। ২০ – ৩০ মিনিট ওখানে কিছু ছবি তুলে আমরা চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

সকালে নাস্তা করে বের হয়েছি, এখন বাজে বেলা ৪টা, ক্ষুধায় পেট চো-চো করছিলো। ২-১ টা মোটামুটি মানের খাবার হোটেল চোখে পড়েছে, বসে পড়লাম মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্যে যদিও খাবারের মান ভালো না। এই সময়ে পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম তাই খাবারের মান আরো যাচ্ছেতাই। ইচ্ছে ছিলো তামাবিলের দিকে যাওয়ার কিন্তু আর হতাশ হতে চাইনা, হাতে সময়ও খুব একটা বেশি নেই কারণ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের অন্তত: সিলেটের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে। ফেরার পথে রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলি।

সিলেট শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। পথে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট দেখেছি কিন্তু কোনো জায়গায় আমাদের আটকায়নি। ডাবল হেলমেট, পিঠব্যাগ দেখে সহজেই হয়তো ধারণা করেছে যে আমরা ঘুরতে এসেছি। শুধুমাত্র সন্ধ্যার পর একজন হাইওয়ে পুলিশ টর্চ জ্বালিয়ে পিছন থেকে বাইকের নাম্বার প্লেট চেক করেছে। আর এটাই স্বাভাবিক কারণ আমরা দেশের একটি সীমান্তের কাছে ঘুরতে এসেছি।

দুলাভাই তার একজন সহকর্মীকে কল করেন, যাতে তিনি আমাদের জন্য সিলেটে একটি হোটেল কিংবা রিসোর্ট ভাড়া করে দেন. কিন্তু সেই ভাই চাচ্ছিলো, আমরা যেন বিশ্বনাথে তার বাসাতেই উঠি. আমরা একটু ইতস্তত: বোধ করলাম কিন্তু উনি বেশ নাছোড়বান্দা, তাই না করতে পারলাম না. ঐদিন এবং পরেরদিন রাত ওনার বাসাতেই থাকি. যে বাসাতে উনারা ভাড়া থাকেন, বাসাটি ৩তলা বিশিষ্ট, বেশ ছিমছাম। বাড়িওয়ালা থাকেন লন্ডনে, কেয়ারটেকারই সব দেখা শোনা করে। ওনারাও আমাদের যেভাবে আপ্যায়ন করেছেন তা সত্যি ভুলার মত নয়। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে এসে রাতে এমন ক্লান্ত হয়ে পরলাম যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও বলতে পারলাম না।

==================================================================